শুভ্র চট্টোপাধ্যায়: ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। সনাতন ধর্মে এই ধারণা বহু পুরনো। ভগবানের কাছে উচ্চ নীচ ভেদ নেই, ভেদ নেই ধনী দরিদ্রের। এই বার্তা দিতেই ছত্তিশগড়ের প্রত্যন্ত জনজাতি এলাকার রামনামি (Ramnami) সমাজের মানুষজন তাঁদের শরীরের বিভিন্ন অংশে ভগবান রামের নাম লেখা ট্যাটু করে। চোখের পাতা থেকে নাক, কান কোনও কিছুই বাদ যায়না। বর্তমান যুবসমাজের কাছে ট্যাটু খুবই পছন্দের, আধুনিকতার ছোঁয়ায় ট্যাটু আজ দেশ বিদেশে সমান জনপ্রিয়। কিন্তু ভারতবর্ষের একটি পিছিয়ে পড়া সমাজ এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে শরীরে ট্যাটু ছাপিয়ে সামাজিক বার্তা দিচ্ছে এমন খবর হয়ত দেশের বড় অংশের মানুষের কাছে নেই। কথিত আছে কোনও এক সময়ে রামনামি (Ramnami) সমাজকে মন্দিরে প্রবেশ করতে এবং হিন্দু দেবতাদের পুজো করার অনুমতি দেয়নি তৎকালীন উচ্চবর্ণের লোকেরা, তখন থেকেই ভগবান সর্বত্র বিরাজমান এই বার্তা দিতে ভগবান রামের নাম লিখে তারা সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে নিয়েছিল এবং তুলসীদাস রচিত রামচরিত মানস নিত্য পাঠ করতে শুরু করেছিল।
গবেষকরা মনে করেন রামের নামে ট্যাটু করার কারণেই এই জনজাতি সমাজের নাম হয়েছে রামনামি (Ramnami) সমাজ। এদের সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবিচ্ছেদ্য অংশ হল রামনাম। শুধুমাত্র শরীরের বিভিন্ন অংশ নয়, তাদের বাড়িঘর থেকে পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুতেই রামনামের ছাপ রয়েছে। দেহে উল্কি আঁকা ছত্তিশগড়ের জনজাতি সমাজের মানুষজনের কাছে অনেক পুরনো অভ্যাস। কিন্তু ভগবানের নামে ট্যাটুর কোনও পুরনো রেকর্ড নেই বলেই জানাচ্ছেন গবেষকরা। রামনামি (Ramnami) সমাজই এক্ষেত্রে প্রথম এবং শেষ উদাহরণ।
রামনামি (Ramnami) আন্দোলন
বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে উনিশ শতকে মধ্য ভারতে বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এবং এই আন্দোলনগুলি মূলত কোনও প্রচলিত প্রথা যা অস্পৃশ্যতার সমর্থক ছিল, সেগুলির বিরুদ্ধে। প্রাচীন এই আন্দোলনগুলির মধ্যে একটি ছিল কবিরপন্থী এবং অপরটি হল গুরু ঘাসীদাসের সতনামি আন্দোলন। এই আন্দোলনগুলি ছিল মূলত অস্পৃশ্যতা এবং জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধে।
অনেক ঐতিহাসিক রামনামি (Ramnami) সমাজকে সতনামী আন্দোলনের একটি শাখা বলে মনে করেন। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে, এই আন্দোলন তথাকথিত নিম্নবর্ণের এক কৃষক পুত্র পরশুরাম ভরদ্বাজ শুরু করেছিলেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ছত্তিশগড়ের জাঞ্জগীর-চাম্পা জেলার চরপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিল। শোনা যায়, খুব ছোটবেলায় রামায়ণের গল্পে তিনি প্রেরণা পেতেন। শৈশবে তিনি নিয়মিতভাবে চাষের কাজে বাবার সঙ্গে মাঠে যেতেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় পরশুরামের। পরশুরাম পড়াশোনা করতে খুব ভালোবাসতেন।
কথিত আছে পরশুরাম একবার কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন এবং কুষ্ঠরোগকে সেসময় পাপ মানা হত। সমাজ জীবন থেকে তাই পরশুরাম সরে যান এবং একজন সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। কথিত আছে, এই সময়ে তিনি একজন ঋষির সংস্পর্শে আসেন। শোনা যায়, ওই ঋষি তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন এবং রামায়ণ পড়া চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পরশুরাম আবিষ্কার দেখেন তিনি কুষ্ঠমুক্ত হয়ে গেছে পরিবর্তে "রাম-রাম" শব্দটি তাঁর বুকে ছাপ আকারে লেখা রয়েছে। এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়তেই পরশুরামের খ্যাতি দূরদূরান্ত অবধি পৌঁছে যায়। তারপর থেকেই পরশুরাম রামায়ণ এবং রামনামের মাহাত্ম্য প্রচার করতে শুরু করেন। স্থানীয় মানুষজনের ভিড় বাড়তে থাকে থাঁর বাসস্থানে। কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর বাসস্থান একটি তীর্থক্ষেত্রের রূপ নেয়। প্রথমে তাঁর তাঁর কাছে দীক্ষা নেন চারজন শিষ্য। জানা যায় তাঁর প্রথম চারজন শিষ্য ভক্তির প্রতীক হিসেবে কপালে ‘রাম-রাম’ ট্যাটু করিয়েছিলেন।
গুরু পরশুরামের উপদেশ
পরশুরাম তাঁর শিষ্যদের উপদেশ দিতেন। তিনি ছিলেন সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে। সারাজীবন জাতিভেদ প্রথা এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন তিনি। তাঁর সামাজিক আন্দোলনের মূলভিত্তিই ছিল রামনাম এবং রামায়ণ। মূলত তাঁর সহজ সরল উপাসনা পদ্ধতি দেখে অনেক মানুষই এই রামনামের আন্দোলনে অংশ নেয়।
ঐতিহাসিকদের মতে রামনাম ট্যাটুর এই আন্দোলন তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের বিরোধীতার মুখে পড়ে। আক্রমণও হয়েছিল রামনামি সমাজের উপর। ঘটনার বিচার চেয়ে আদালতের দারস্থ হতে হয় তৎকালীন রামনামি সমাজের নেতাদের। রক্ষণশীল সমাজের দাবি ছিল 'রাম' নাম উচ্চারণ করার অধিকার শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের লোকেদেরই আছে। আদালতের বিচারক রক্ষণশীল সমাজের এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। আদালত সেসময় রায় দেয়,ভগবান রামের নাম যে কেউ ব্যবহার করতে পারেন। রামনামি সমাজের কাছে আদালতের এই রায় ছিল বড় জয়।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।
+ There are no comments
Add yours