মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: বছর পঞ্চান্নের ঈপ্সিতা দত্ত। বুকের চিন চিনে ব্যথা মাঝে মধ্যেই অনুভব করেন। চিকিৎসক নানান পরীক্ষা করে জানালেন তিনি হৃদরোগে ভুগছেন। দ্রুত অস্ত্রোপচার জরুরি। খরচ আনুমানিক চার লাখ টাকা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত দত্ত পরিবারের কাছে নগদ টাকা না থাকলেও স্বাস্থ্য সাথী কার্ড (Swasthya Sathi) রয়েছে। কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলেন ঈপ্সিতা। কিন্তু অভিযোগ, ওই বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিলেন, তাঁদের হাসপাতালে বেড ফাঁকা নেই। তাই ঈপ্সিতা দেবীকে ভর্তি করানো যাবে না। তবে, অগ্রিম নগদ দিয়ে বেড বুক করিয়ে গেলে অবশ্য কিছু দিনের মধ্যে ব্যবস্থা করানো যাবে।
বছর তিরিশের তপন কর্মকার গলব্লাডার স্টোনের সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি রুবি হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। অভিযোগ, স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের অধীনে চিকিৎসা করাবেন জানার পরেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, অপেক্ষা করতে হবে। চিকিৎসকের কাছে রোগীর লম্বা লাইন। তাছাড়া শল্য চিকিৎসক বিশেষ নেই। তাই কবে অপারেশনের ডেট পাওয়া যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
বাড়িতেই স্ট্রোক হয় বছর পয়ষট্টির অনিতা বসুর। মেয়ে নিয়ে যায় ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেসে। সেখানে নানান পরীক্ষা করে চিকিৎসক জানান, ভর্তি করানো জরুরি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিন্তু স্বাস্থ্য সাথী কার্ডে পরিষেবা দিতে নারাজ। পরিবারের অভিযোগ, প্রথমে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হলেও কয়েক ঘণ্টা পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, আপাতত তাদের রোগী পরিষেবা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। রোগীর চাপ অনেক। তাই অন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হোক। সরকারি হাসপাতালেও ভর্তির সুযোগ না পেয়ে অনিতা বসুর এখন বাড়িতেই চিকিৎসা চলছে। ফলে, শারীরিক অবস্থার বিশেষ উন্নতিও হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: পুরুষের তুলনায় বাঙালি মহিলারা নিরাপদ যৌন সংসর্গে বেশি আগ্রহী, বলছে কেন্দ্রীয় রিপোর্ট
অনিতা বসু, ঈপ্সিতা দত্ত কিংবা তপন কর্মকার কোনও ব্যতিক্রম নন। রাজ্যের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য সাথী কার্ডে পরিষেবা পেতে গিয়ে এমনি নাজেহাল হচ্ছেন অধিকাংশ মানুষ। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, রাজ্যের সব মানুষ নিখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা পাবেন। শুধু সরকারি হাসপাতালে নয়, সমস্ত বেসরকারি হাসপাতালে মানুষ এই পরিষেবা পাবেন। চিকিৎসা খরচ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য সাথী কার্ডে পাওয়া যাবে।
যদিও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের ছবিটার পার্থক্য অনেকটাই বলে মনে করছেন অনেকেই। আশঙ্কার মেঘ অবশ্য দেখা দিয়েছিল, রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যসচিবের কথায়। মুখ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্য সাথী নিয়ে ঘোষণা করার কয়েক দিনের মধ্যেই এক বৈঠকে তৎকালীন মুখ্য সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, নির্বাচনের আগে অন্তত কোনও বেসরকারি হাসপাতাল যাতে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড থাকা রোগীকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকার না করে, সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্ন উঠেছিল, তাহলে কি স্বাস্থ্য সাথী শুধুই 'বিজ্ঞাপন'? ভোট জয়ের অস্ত্র? সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার কি সুনিশ্চিত হবে না?
হাসপাতালে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির ছবি যেন আশঙ্কাগুলোকেই সত্যি করছে। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একাংশ জানাচ্ছেন, স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে প্রত্যেক অপারেশন ও চিকিৎসার যে প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কার্যত অবাস্তব। তাছাড়া স্বাস্থ্য সাথীর টাকা পাওয়ার পদ্ধতি ও বেশ দীর্ঘ প্রসারি। এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা বলেন, "শুধুমাত্র দানের জন্য বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে তোলা হয় না। বেসরকারি হাসপাতালে বিনিয়োগ হয় লাভের জন্য। তিক্ত হলেও এটাই বাস্তব। কোনও শিল্পপতি, ব্যবসায়ী শুধুমাত্র সমাজের ভালোর জন্য বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে তোলেন না। লাভ করার জন্য গড়ে তোলেন। স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে যে ভাবে বেসরকারি হাসপাতালকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেটা বাস্তব সম্মত না।" দক্ষিণ কলকাতার আরেক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা বলেন, "এই প্রকল্প শুরু করার আগে আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হয়নি। আমাদের উপরে কার্যত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটা বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা করলে হয়তো সাধারণ মানুষ আরও ভালো পরিষেবা পেত। এভাবে সবাইকে অলাভজনক ভাবে দীর্ঘদিন পরিষেবা দিলে হাসপাতালে তালা পড়বে।"
আরও পড়ুন: রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল নির্বাচন 'নির্মল' হবে কিনা সংশয়ে চিকিৎসকরা
তবে, প্রশাসনের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করতে না পেরে রোগী হয়রানিকে অবশ্য সমর্থন করছেন না চিকিৎসকরা। মুকুন্দপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা ও চিকিৎসক জানান, বেসরকারি হাসপাতালে একটি অস্ত্রোপচার করতে যে অর্থ চিকিৎসকের জন্য বরাদ্দ, তার থেকে কয়েক গুণ কমে স্বাস্থ্য সাথীতে চিকিৎসকদের পরিষেবা দিতে হয়। তাঁর কথায়, "এটা বাস্তব যে বেসরকারি হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসকদের একাংশের মধ্যে স্বাস্থ্য সাথী আওতায় থাকা রোগীকে পরিষেবা দিতে অনীহা দেখা যায়। তার কারণ, একটি অস্ত্রোপচার করতে একজন চিকিৎসক যে সময় বরাদ্দ করেন, স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে তিনি সেই অনুপাতে পারিশ্রমিক পান না। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া একটা পেশা। শুধুই সমাজসেবা নয়।"
স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প নিয়ে স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশের মত, বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা না করলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে না। কম খরচে পরিষেবা দেওয়া নিয়ে আরও বেশি আলোচনা জরুরি। শুধুই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া নয়। বরং বেসরকারি হাসপাতালগুলো কী চাইছে, সেটাও শোনা জরুরি। কিন্তু খোলামেলা আলোচনা হয় না। বরং অধিকাংশ সময়েই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাই প্রশাসনের সামনে নীরব থাকলেও পরে পরিষেবা দিতে চায় না বেসরকারি হাসপাতালগুলো। যার জেরে ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষ।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।
+ There are no comments
Add yours