Jogendra Nath Mandal: ‘‘কেন আমি দলিত মুসলিম ঐক্যের প্রতি আস্থা হারালাম?’’

পাকিস্তানের প্রথম আইন এবং শ্রমমন্ত্রী ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। ১৯৫০ সালের ৯ অক্টোবর তিনি পদত্যাগ করেন লিয়াকত আলি খানের মন্ত্রিসভা থেকে। তাঁর পদত্যাগপত্র সাতটি পর্বে প্রকাশ করছি আমরা।
jogen
jogen

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি -পর্ব ৩

দ্বিতীয় পর্বের পর...

কিছু ঘটনা

১১। প্রথম যে ঘটনা আমাকে মর্মাহত করে তা ঘটেছিল গোপালগঞ্জের দিঘারকুল গ্রামে। সেখানে স্থানীয় নমঃশূদ্রদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা মিথ্যা অভিযোগে গুজব রটিয়ে বর্বরতা চালায়। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে একজন মুসলিম জেলে মাছ ধরতে জাল ছুঁড়ে মারে। একজন নমঃশূদ্র একই উদ্দেশ্যে জাল ছুঁড়ে মারে। এই নিয়ে দুইজনের ভিতর কথা কাটাকাটি হয়। মুসলিম যুবক গ্রামে গিয়ে মিথ্যা গুজব রটায় যে তাকে এবং এক মহিলাকে নমঃশূদ্ররা আক্রমণ করেছে। গোপালগঞ্জের উপ জেলা প্রশাসক সে সময় নৌকায় করে সে জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কাছে অভিযোগ করলে তিনি কোন তদন্ত ছাড়াই সশস্ত্র পুলিশ পাঠান নমঃশূদ্রদের দমন করতে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় মুসলিমরা যোগ দেয়। তারা নমঃশূদ্র হিন্দুদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। তাদের হামলায় বাড়িঘর ধ্বংস হয়, প্রচুর নারী পুরুষ আহত হয়। শেষ সহায় সম্বলটুকু লুট করে নিয়ে যায় মুসলিমরা। এক হিন্দু মহিলা যিনি কিনা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তাঁকে পিটিয়ে গর্ভপাত করে দেয় তারা। বিশাল এলাকা জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ১

১২। হিন্দুদের উপর পুলিশ দিয়ে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের পরের ঘটনা ঘটে ১৯৪৯ সালের শুরুতে। বরিশাল জেলার গৌরনদীর পুলিশ সুপারের অধীনে। একটি ইউনিয়ন বোর্ডের দুটি গ্রুপের মধ্যে ঝামেলা হয়। একটি গ্রুপ যারা ছিল পুলিশের কাছের। তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ষড়ষন্ত্র করতে শুরু করে। এবং তাদের কমিউনিস্ট বলে চালিয়ে দেয়।  তারা এও বলে ঐ পক্ষ পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করবে। গৌরনদী থানার ওসি এই শুনে কোনরকম সত্যতা যাচাই না করে হেডকোয়ার্টার থেকে পুলিশের রিসার্ভ ব্যাটেলিয়ন নিয়ে আসেন। পুলিশ বাহিনী বিশাল এলাকা অবরুদ্ধ করে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ চালায়। প্রচুর লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। শিক্ষক এবং ছাত্রদের কমিউনিস্ট সন্দেহে আটক করা হয়। তাদের উপর নির্যাতন চালানো হয়। আমি ঘটনাটা জানতে পারি কারণ ঘটনাস্থল আমার গ্রামের বাড়ির কাছেই। আমি জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারকে জানাই এবং নির্দেশ দিই ঘটনার তদন্তের জন্য। কিন্তু আমার চিঠিতে কোন কাজ হয় নাই। আমি তখন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ মহল মানে আপনার কাছে ঘটনাটা জানাই। কিন্তু আপনি কোন ব্যবস্থা নেন নাই।

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ২

সামরিক বাহিনী দিয়ে মহিলাদের উপর নির্যাতন

১৩। সিলেট জেলার হাবিবগড়ের নিরীহ হিন্দুদের উপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর অত্যাচারের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি। নিরীহ হিন্দু এবং মহিলাদের উপর  নির্মমভাবে নির্যাতন চলানো হয় এখানে। বিশেষ করে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এর শিকার হয়। মহিলাদের শ্লীলতাহানি করা হয় এবং তাদের বাড়িঘরে লুটপাট চলে। পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় মুসলিমরা যোগ দেয়। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে হিন্দু মহিলাদের নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়। আমি আপনার কাছে এই ঘটনার কথাও রিপোর্ট করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনি তদন্তের আশ্বাস দিয়েও এর কোন সুরাহা করেন নাই।

১৪। রাজশাহীর নাচোলে একটি ঘটনার কথা বলি। কমিউনিস্টদের দমনের নামে পাকিস্তানের পুলিশ স্থানীয় মুসলিমদের নিয়ে হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালায় এবং তাদের সম্পদ লুটপাট করে। স্থানীয় সাঁওতালরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। তারা সেখানে তাদের উপর চালানো বর্বরতার কথা বলে।

১৫। খুলনা জেলার মোল্লারহাটের অন্তর্গত কালশিরা গ্রামে ১৯৪৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ঘটে যাওয়া ঘটনাটি খুবই নির্মম এবং ঠাণ্ডা মাথায় ঘটানো একটি ঘটনার উদাহরণ। সেদিন গভীর রাত্রে কালশিরা গ্রামের জনৈক জয়দেব ব্রহ্মার বাড়িতে সন্দেহজনক কমিউনিস্টদের খোঁজে ৪ জন কনস্টেবল হানা দেয়। পুলিশ আসার খবর পেয়ে জনা ছয়েক তরুণ তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো কমিউনিস্টও ছিল তারা বাড়িটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ বাড়িতে ঢুকে জয়দেব ব্রহ্মার স্ত্রী এর উপর আক্রমণ চালালে তার চিৎকার জয়দেব ব্রহ্মা এবং বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া তার কিছু সঙ্গীর কানে আসে ওই চিৎকার। মরিয়া হয়ে তারা গৃহে পুনঃপ্রবেশ করে এবং ৪ জন কনস্টেবলকে কেবলমাত্র একটি বন্দুক সহ পায়। সম্ভবত এই দৃশ্য তাদের উৎসাহিত করে এবং তাদের আঘাতে অস্ত্রধারী কনস্টেবলটি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। তারা তারপর দ্বিতীয় কনস্টেবলের উপরও হামলা চালালে বাকি ২ জন সেখান থেকে পালিয়ে যায় এবং আশেপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা চিৎকার করতে থাকে। ঘটনা ঘটেছিল ঠিক সূর্যোদয়ের আগে তখন ছিল পুরো অন্ধকার। তাই গ্রামবাসীরা এগিয়ে আসবার আগেই রাতের অন্ধকারে অপরাধীগণ মৃতদেহসহ গা ঢাকা দেয়। পরদিন বিকেলে খুলনার এস.পি. একদল মিলিটারি এবং আর্মড পুলিশসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ইতিমধ্যে অপরাধীরা এবং জয়দেব ব্রহ্মার প্রতিবেশীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। কিন্তু বেশিরভাগ গ্রামবাসীই তাদের নিজ গৃহেই রয়ে যায় কারণ তারা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে সে সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই ছিলনা। এর পর এসপি, মিলিটারি ও আর্মড পুলিশ পুরো গ্রামজুড়ে নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার শুরু করে এবং আশেপাশের মুসলিমদের লুটপাটে প্ররোচিত করে। বেশকিছু মানুষ নিহত হয়, বহু হিন্দু নর-নারীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। অনেক বাড়িতে ঢুকে দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙচুর করা হয়, পূজোর স্থান অপবিত্র ও ধ্বংস করে দেয়া হয়। পুলিশ, মিলিটারি এবং স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য কর্তৃক হিন্দু মহিলারা ধর্ষিত হন। এভাবে শুধুমাত্র এক থেকে দেড় মাইল দৈর্ঘ্যের গ্রাম, এক বিরাট জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল কালশিরাই নয়, এর আশেপাশের বেশকিছু নমঃশূদ্র গ্রামও বাস্তবিক অর্থে নরকে পরিণত হয়। কালশিরা গ্রামটি কখনই কমিউনিস্ট কার্যকলাপের জন্য সন্দেহের তালিকাভুক্ত ছিল না। কালশিরা থেকে ৩ মাইল দূরবর্তী ঝালরডাঙ্গা গ্রামটি কমিউনিস্ট কার্যকলাপের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ঘটনার দিন এই গ্রামটিতে সন্দেহভাজন কমিউনিস্টদের ধরতে পুলিশের এক বিরাট বাহিনী হানা দিলে তাদের কিছু সংখ্যক পালিয়ে কালশিরা গ্রামের পূর্বোল্লিখিত বাড়িতে আশ্রয় নেয় যা তাদের কাছে নিরাপদ আত্মগোপনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।

(ক্রমশ............)

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ২

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ১

 

দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।



Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles