মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: মুর্শিদাবাদ জেলার খাগড়ায় তিন নম্বর গিরিজা চক্রবর্তী লেনের সেন বাড়ির আদি দুর্গাপুজোর মাহাত্ম্যই আলাদা। বংশধর সুবীর সেন জানালেন, এই বাড়ির উৎসব ১৮৯৬ সালে রাধাকৃষ্ণ সেনের হাত ধরে শুরু হয়েছিল। যদিও এক্ষেত্রে আসল ভূমিকা গ্রহণ করেন তাঁরই বাল্যবিধবা কন্যা বিন্দুবাসিনী দেবী, যিনি অনেক আগে থেকেই এখানে জগদ্ধাত্রী পুজো করতেন বলে জানা যায়। এই পুজোর শুভ সূচনা হয় সোজা রথের দিন। এদিন পুরোহিত এবং মৃৎশিল্পীরা প্রতিমার কাঠামোতে গঙ্গামাটির প্রলেপ দিয়ে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। দুর্গাপ্রতিমা গড়া হয় বাড়ির ঠাকুরদালানে। মূল পুজো শুরু হয় ষষ্ঠীতে কলস এবং গারু সহযোগে ভাগীরথী থেকে ঘট স্নানের মাধ্যমে। বাড়িতে সাত রকমের ফল, বেলপাতা ও সোলার কদম ফুল দিয়ে তৈরি হয় রচনা। ষষ্ঠীর দিন বাড়ির ঠাকুরদালানে এটি টাঙানো হয়। এটি সেন বাড়ির পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
নবমীতে আখ ও চালকুমড়ো বলি
এই সেন বাড়ি্র পুজোয় বেশ কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সন্ধি পুজোতে ১৩৮টি পদ্ম, ১০৮টি ঘিয়ের প্রদীপ এবং ১০৮টি বেলপাতা দেবীকে নিবেদন করা হয়। পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। তাই এই পুজোতে পশুবলি নিষিদ্ধ। তবে নবমীতে আখ ও চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। সেন বাড়ির দশমীর পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য অপরাজিতা পুজোঘট বিসর্জন। দর্পণে বিসর্জনের মাধ্যমে পুজোর সমাপ্তি ঘটে। দশমীর দিন বিকেল বেলায় স্থানীয় মুটিয়াদের কাঁধে চেপে বাড়ির দিকে মুখ করে রওনা দেন মা দুর্গা।
মাহাত্ম্য কম নয়
সেন বাড়িতে ভোগ হয় নিরামিষ। এখানে কখনই দেবীকে রান্না করা অন্য ভোগ দেওয়া হয় না। এর পরিবর্তে লুচি, বিভিন্ন তরকারি, শাকভাজা, পাঁপড় ও বাড়িতে তৈরির নারকেলের নাড়ু দেওয়া হয়। নবমীর জন্য পাকা কলার বড়া, পটলপোড়া টক, পালং শাক দেওয়ার রেওয়াজ এখনও রয়েছে। দেবীর ভোগে কোনও রকম তেল, হলুদ, লবণ ব্যবহার করা হয় না। এর পরিবর্তে গাওয়া ঘি আর লবণের পরিবর্তে সন্দক লবণ ব্যবহার করা হয়। ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন ১৭টি করে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এই দুর্গাপুজোর মাহাত্ম্য কম নয়। শোনা যায়, আজ থেকে বহু বছর আগে সপ্তমীর ঘট ভরে ফেরার পথে কোনও ভাবে ভুলক্রমে পুরোহিতের পা স্পর্শ করে ওই দিনই তাঁর মৃত্যু ঘটে। ঠাকুরের মহিমায় পুজো অতীতের সেই নিয়ম, রীতি-নিষ্ঠা বজায় রেখে আজও চলছে।
বরাবরই মহিলাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য
এই বাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল বিন্দুবাসিনী দেবীর ইচ্ছা অনুসারে। পরবর্তী সময়ে সুচন্দ বদনী দেবী তাঁর নিষ্ঠা, ভক্তি, একাগ্রতা ও সাধনার মাধ্যমে এই পুজোকে আগলে রেখেছিলেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে এই বাড়িতে কয়েক বছর সন্ধিপুজোর সময় কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হত। পরবর্তীকালে তাঁর মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র বধুশর্মা সেন আমৃত্যু পুজোর প্রতি কর্তব্যে অবিচল ছিলেন। ১৯৭৪ সালে যোগেশচন্দ্র সেন এবং ১৯৭৯ সালে সুচন্দ্র বদনী দেবীর মৃত্যুর পর তাঁদের বংশধররা এই পুজো চালাতে থাকেন। সুচন্দ বদনী দেবীর ষষ্ঠ পুত্র স্বর্গীয় প্রশান্ত কুমার। তিনি সিভিল সার্ভিস অফিসার। প্রশান্তবাবু পুজো পরিচালনা, সংস্কার ও অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে দশমীর সন্ধ্যায় দেবীর নৌকায় ভাগীরথী ভ্রমণ সম্ভব হয়ে উঠেছিল।
বহু উত্থান-পতন, পারিবারিক কলহ, পরিবারের সদস্যদের পেশাগত কারণে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া তথা জমিদারি প্রথা বিলোপের সাক্ষী সেনবাড়ির এই দুর্গাপুজো। সুবীর সেন বলেন, মহালয়ার দিন মহামায়ার নেত্রদান করা হয়। সবুজ বর্ণের মহিষাসুরের সঙ্গে মহিষ অনুপস্থিত। এই সেন বাড়ির দেবী দুর্গা ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে যে শাল কাঠের কাঠামোতে শুরু হয়েছিল, আজ অবধি সেই শাল কাঠের কাঠামোতেই পুজো হয়ে আসছে বলে জানান সেন বংশের বংশধর সুবীর সেন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours