মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: জেলে মাস্টারদার (Masterda Surya Sen) সঙ্গী ছিল চারটি বই। গীতা, চণ্ডী, মহাভারত আর রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’। গীতাই মৃত্যুভয় দূর করতে সাহায্য করেছিল মাস্টারদা-সূর্য সেনকে। মহান বিপ্লবী এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, মানুষ যেমন জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করে নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নূতন দেহ ধারণ করে। কবি বলছেন, মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। মানুষ এত সুন্দর লেখা পড়েও উপলব্ধি করতে পারে না বলেই কি মৃত্যুকে ভয়ের জিনিস বলে মনে করে?’ এই মৃত্যুভয়কে চুচ্ছ করেই দেশ সেবায় ব্রতী হয়েছিলেন মাস্টারদা। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল, চট্টগ্রাম জালালাবাদ পাহাড়ে (Battle of Jalalabad Hill) মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বেই বিপ্লবী এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের মধ্যে এক অসম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীরা লড়াই করে, পরাজিত হলেও। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
২২শে এপ্রিল ১৯৩০: জালালাবাদ যুদ্ধ
২২শে এপ্রিল ১৯৩০। জালালাবাদ যুদ্ধ (Battle of Jalalabad Hill) । মাস্টারদা পুরো দলবলসহ এসে পৌঁছলেন জালালাবাদ পাহাড়ের নিচে। সিদ্ধান্ত হল পাহাড়ে চড়ার। ওইদিন সবাই যখন ভোরবেলা মাস্টারদার নেতৃত্বে পাহাড়ে চড়েছেন সেইদিন বিকেল চারটের সময় চট্টগ্রাম নাজিরহাট শাখা রেল লাইনের ‘ঝরঝরিয়া বটতলা’ মসজিদের পাশে এসে থামল একটি ট্রেন। রেলগাড়ি থেকে নেমে এল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস ও সুর্মা ভ্যালি লাইট ইনফ্যান্ট্রির সশস্ত্র সেনাবাহিনীর দল। তারা রওনা হল জালালাবাদ পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের দুদিকে অন্য দুটো উঁচু পাহাড়ের মাথায় বসানো হল মেশিনগান।ইতিমধ্যে বিপ্লবী লোকনাথ বলের নির্দেশে আটভাগে বিপ্লবীদের বাহিনীকে পাহাড়ের চারপাশে সাজানো হল। এইদিকে পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে ব্রিটিশ সেনার দল। নিঃশ্বাস চেপে তরুণ বিপ্লবী দল অপেক্ষা করছে নেতৃত্বের নির্দেশের। ওপর থেকে গাছের আড়ালে থেকে লড়াইয়ের যে সুবিধা আছে তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করল ‘অনুশীলন এবং যুগান্তরের’ সমন্বয়ে গঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মি’র তরুণ যোদ্ধারা। পাহাড়ের কোলে একে একে লুটিয়ে পড়ল ব্রিটিশ সেনা।
যদি প্রাণ থাকে, যদি বাঁচানো যায়
কিন্তু অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে বেশিক্ষণ মনের জোরে লড়াই চালাতে পারলেন না বিপ্লবীরা। সেনার গুলিতে প্রাণ হারালেন লোকনাথ বলের অনুজ হরিগোপাল বল ওরফে টেগরা। দুদিকের পাহাড় থেকে বৃষ্টিধারার মতো মেশিনগানের গুলি ছুটে আসছে। একে একে মৃত্যুবরণ করলেন ১২ জন বিপ্লবী হরিগোপাল বল অন্য নাম টেগরা, প্রভাস বল, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, বিটু ভট্টাচার্য, মতি কানুনগো, অশোক দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাশগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিন চন্দ্র ঘোষ ও অর্ধেন্দু দস্তিদার। একটা একটা করে দেহ আসে আর মাস্টারদা বুকের ওপর কান রেখে বসে থাকেন কিছুক্ষণ, যদি হৃদপিণ্ডের স্পন্দন শোনা যায়! যদি প্রাণ থাকে, যদি বাঁচানো যায়। ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারে বিপ্লবীদের শক্তি বুঝতে না পেরে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি দেয় সেনা। সেই সুযোগেই আত্মগোপনের চেষ্টা করেন সূর্য সেন-সহ অন্যান্য বিপ্লবীরা।
চট্টগ্রামে চারদিনের স্বাধীনতা
২২-শে এপ্রিল রাত্রে জালালাবাদ পাহাড় (Battle of Jalalabad Hill) থেকে নেমে আসার পরে আবার চলা শুরু হল। এদিকে ক্ষিদে-তেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত তবু চলতেই হবে। কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। শত্রুপক্ষ জেনে গেছে বিপ্লবীদের আশ্রয়। জালালাবাদ পাহাড় থেকে দূরে, আরও দূরে সরে যেতেই হবে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল, মধ্যরাতে সহ বিপ্লবীদের নিয়ে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুঠ করেছিলেন মাস্টার দা। প্রথমে টেলিফোন ও টেলিগ্রাম ধ্বংস করা, ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ, চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ বিপ্লবী বাহিনীর কাছে চলে যাওয়ার পর চার দিন চট্টগ্রাম শহর স্বাধীন ছিল। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল সংঘটিত ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধের পর ব্রিটিশ শাসকেরা আবার চট্টগ্রাম শহরের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। এরপরেও তিন বছর গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যান মাস্টার-দা।
সূর্যকুমার সেন থেকে ‘মাস্টারদা’
বিপ্লবী সূর্য সেনের আসল নাম সূর্যকুমার সেন (Masterda Surya Sen)। ডাকনাম কালু। জন্মেছেন ২২ মার্চ, ১৮৯৪। তদানীন্তন চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় বাস ছিল তাঁদের। মা শশীবালা সেন এবং বাবা রাজমণি সেন। দুই পুত্র ও চার কন্যা রেখে তাঁদের অকালপ্রয়াণের পর কাকা গৌরমণি সেনের কাছে বড় হন সূর্য সেন। পড়াশোনা দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়, নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়, নন্দনকাননের ন্যাশনাল হাইস্কুল হয়ে চট্টগ্রাম কলেজ। কিন্তু তৃতীয়বর্ষের কোনও এক সাময়িক পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলে পড়তে আসেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। সেখান থেকে বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে সেই ন্যাশনাল হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০-২২) সময় স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে দেওয়ানবাজারে অধুনালুপ্ত উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় থেকেই বিপ্লবীদলের সঙ্গে তাঁর সখ্য গভীরতর হয় এবং হয়ে ওঠেন বিপ্লবীদের ‘মাস্টারদা’।
মরদেহ দেওয়া হয়নি পরিবারকে
১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এক বিশ্বাসঘাতকের চক্রান্তে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন সূর্য সেন। জেলে মাস্টার দার সঙ্গী ছিল গীতা, মহাভারত ও রবীন্দ্র-রচনা। বন্দি দশায় ভোরে উঠে স্তোত্র পাঠ করতেন মাস্টার দা। ১৯৩৩ সালে বিশেষ আদালতে বিচার হয় সূর্য সেনের। ১৪ আগস্ট সূর্যসেনকে ফাঁসির নির্দেশ দেয় ব্রিটিশ সরকার। ফাঁসির আগে মাস্টারদা ওপর নির্মম অত্যাচার করে ব্রিটিশ পুলিশ। নৃশংসভাবে পিটিয়ে হাতুড়ি দিয়ে সূর্য সেনের দাঁতগুলি ভাঙে, নখগুলি থেঁতো করে উপড়ে ফেলে, গোটা শরীরের সমস্ত হাড়পাঁজরা টুকরো টুকরো করে। অত্যাচারের চোটে চৈতন্য হারান সূর্য সেন। সেই অবস্থাতেই ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি ফাঁসি দেওয়া হয় সূর্য সেনকে। এমনকি সরকারিভাবে মৃত্যুঘোষণার পরে সূর্য সেনের মরদেহ পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে সৎকারের ব্যবস্থাও করা হয়নি। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যে কোনও জায়গায় লোহার টুকরো বেঁধে তাঁর দেহ ডুবিয়ে দেয় ব্রিটিশ পুলিশ।