মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ম্যানহোলে মানুষ নামিয়ে চলছে পরিষ্কারের কাজ। বানতলায় লেদার কমপ্লেক্সে ম্যানহোলে নেমে মৃত্যু ৩ সাফাইকর্মীর। এই ঘটনায় দায় কার? বানতলায় ম্যানহোলকাণ্ডে তদন্তের দাবি তুললেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তাঁর মতে, ‘‘মারা গিয়েছে আমরা ভুল বলছি। মারা যায়নি, খুন করা হয়েছে।’’
সরকারের ব্যর্থতা
আইন তৈরি করে ম্যানহোলে মানুষ নামানো নিষিদ্ধ করা হলেও ম্যানহোল, সেপটিক ট্যাঙ্কের আবর্জনা পরিষ্কার করতে মানুষ নামানো বন্ধ হয়নি রাজ্যে। প্রাণের ঝুঁকি থাকলেও সামান্য রোজগারের আশায় প্রান্তিক অংশের মানুষ বাধ্য হন এই কাজ করতে। কিন্তু ন্যূনতম সুরক্ষা সরঞ্জামও পান না তাঁরা। ফলে মৃত্যু কার্যত অবধারিত হয়ে ওঠে। বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাসরোধ হয়ে প্রাণ হারান তাঁরা। বারবার সাফাইকর্মীদের সুরক্ষার দাবি উঠলেও সরকার কানে তোলেনি। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাফাইকর্মীদের পা ধুইয়ে দিলেও তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে আলো জ্বালানোর কোনও চেষ্টা করেনি মমতা সরকার। এমনকী মৃত সাফাইকর্মীদের অনেকের পরিবার পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণও পায় না।
কী ঘটেছিল
রবিবার সকাল ৯টা নাগাদ বানতলার লেদার কমপ্লেক্সে সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে ম্যানহোলে পড়ে যান তিন শ্রমিক। প্রথমে এক জন ম্যানহোলে নেমেছিলেন। দীর্ঘ ক্ষণ পরেও তিনি উঠে না-আসায় বাকি দু’জন সেখানে নামেন। ওই নালার গভীরতা ছিল ১০ ফুট। বর্জ্যমিশ্রিত তরলে ডুবে গিয়েছিলেন তাঁরা। দুর্গন্ধে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। লেদার কমপ্লেক্স থানার পুলিশ, দমকল এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরা প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় তিন জনের দেহ উদ্ধার করেন। দেহগুলি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। ওই তিন জন কলকাতা পুরসভার (কেএমডিএ) অস্থায়ী কর্মচারী বলে জানা গিয়েছে। লেদার কমপ্লেক্সের ভিতরে সেক্টর ৬ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অধীনে সাফাইয়ের কাজ করছিলেন তাঁরা।
সুকান্তর দাবি
এই দুর্ঘটনার পরে আঙুল উঠছে প্রশাসনের দিকে। নর্দমা সাফাইয়ের দায়িত্ব বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া হয়ে থাকে। বড় নিকাশি নালার ক্ষেত্রে মূলত যন্ত্রের সাহায্যে সাফাই করা হয়। ছোট নর্দমাগুলির ক্ষেত্রে (যেগুলির উচ্চতা কোমরসমান) সংস্থাগুলি কর্মীদের ব্যবহার করে সাফাইকাজ করে থাকে। তবে সেই সব দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই ঘটনায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘লেদার কমপ্লেক্সের ওখানে কী ধরনের বর্জ্য যায়, আপনারা জানেন। সেই বর্জ্যপদার্থ, তার উপস্থিতিতে মিথেন গ্য়াস থেকে শুরু করে অন্য়ন্য বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয় সেখানে। তিনজন এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছে। আমি তো শুনেছি আরও লোক নাকি ঢুকেছিল, তাঁরা কতটা সুস্থ আছে, খবর নেওয়া উচিত। যাঁরা দায়ী, তাঁদের গ্রেফতার করা উচিত।’’
সুপ্রিম কোর্টের সতর্কতা
ম্যানহোলে মানুষ নামানোর কাজ বা ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ নিয়ে মাত্র চার দিন আগে কলকাতা-সহ দেশের ছয় শহরকে সতর্ক করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু এবং হায়দরাবাদের প্রধান নির্বাহী কর্তাদের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত হলফনামা চাওয়া হয়েছে। ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা জমা দিতে হবে। ১৯ তারিখ শীর্ষ আদালতে এই সংক্রান্ত মামলার পরবর্তী শুনানি রয়েছে। আদালত জানতে চেয়েছে, এই শহরগুলিতে ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ বন্ধ করার জন্য কী পদক্ষেপ করেছে প্রশাসন। হলফনামা আকারে সেটাই জানাতে বলা হয়েছে।
আইনত নিষিদ্ধ
ভারতে ম্যানহোল বা নিকাশি নালায় মানুষ নামিয়ে কাজের ব্যবস্থা ১৯৯৩ সাল থেকে বেআইনি। ২০১৩ সালে নতুন করে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আইনে বলা হয়, ম্যানহোল সাফাই, মলমূত্র সাফাই বা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ কোনও মানুষকে দিয়ে করানো যাবে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে ম্যানহোলে নামাতে হলেও সংশ্লিষ্ট সাফাইকর্মীর জীবন এবং স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা
বিশেষ পরিস্থিতিতে ম্যানহোলে মানুষ নামাতে হলে কী কী নির্দেশিকা মানতে হবে, বিশদে জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। বলা হয়েছিল, নিকাশি নালায় প্রাণঘাতী বিষাক্ত গ্যাস রয়েছে কি না, সে সম্বন্ধে আগে নিশ্চিত হতে হবে। ম্যানহোলে নামার আগে সাফাইকর্মীদের কোমরে দড়ি বেঁধে দিতে হবে। তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাঁদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিশেষ অ্যাপ্রনে ঢাকতে হবে। বিশেষ ধরনের মুখোশ পরে ম্যানহোলে নামতে পারবেন সাফাইকর্মীরা। তাঁরা পায়ে গামবুট এবং হাতে দস্তানা পরে ম্যানহোলে নামবেন। লেদার কমপ্লেক্সের ঘটনায় কোনও নির্দেশিকাই মানা হয়নি বলে অভিযোগ।
ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ঘিরে বিতর্ক
রবিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে মৃত তিন সাফাইকর্মীর পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। যা, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বেঁধে দেওয়া আর্থিক ক্ষতিপূরণের পরিমাণের তিনভাগের একভাগ মাত্র! মন্ত্রী বলেছেন, ‘‘নির্দেশ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেব আমরা। ১০ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে।’’ এ দিকে ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভট্ট এবং বিচারপতি অরবিন্দ কুমারের বেঞ্চ জানিয়েছিল, নিকাশি নালা পরিষ্কার করতে নেমে সাফাইকর্মীর মৃত্যু হলে ৩০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারকে। সেই রায়ের প্রতিলিপির ৪৫ এবং ৪৬ নম্বর পাতায় সে কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। শীর্ষ আদালতের নির্দেশ, ম্যানহোলে নেমে কোনও সাফাইকর্মীর শরীরের কোনও অঙ্গ স্থায়ী ভাবে অকেজো হয়ে গেলে তাঁকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ২০ লক্ষ টাকা দিতে হবে। তবে ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ কখনওই ১০ লাখের কম হবে না।