মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। বিশ্বব্যাপী আজকের দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day) হিসেবে পালিত হয়। কেন এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ? কোথায় জুড়ে এর তাৎপর্য? বর্তমান পৃথিবীতে প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এমন সময় দেখা যাচ্ছে আমরা মাতৃভাষা (Mother Language) থেকে যেন ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছি। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। আজকের দিনে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ইংরেজি ভাষা। এটা মনে করা হয় যে ইংরেজিতে সাবলীলভাবে যিনি কথা বলতে পারেন, তিনি বেশি শিক্ষিত। যিনি পারেন না তিনি কম শিক্ষিত।
মাতৃভাষার অনুভূতি (Mother Language)
আমাদের ভাবা দরকার মাতৃভাষার (Mother Language) গুরুত্ব কমিয়ে অপর ভাষায় সাবলীল হওয়াটা কি সত্যিই গর্বের? বাড়িতে আমরা যে অনুভূতিটা পাই, যে আরাম পাই, যে ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, মাতৃভাষার ক্ষেত্রেও ঠিক অনেকটা একই রকম। নিজের মাতৃভাষায় কথা বললে মনে হয় যেন আমরা বাড়িতে রয়েছি। আমরা বিদেশে গিয়েও যদি কারও সঙ্গে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলি তখন আমাদের অনুভব হয় যে আমরা হয়তো নিজের বাড়িতেই রয়েছি। ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের দিকে যদি আমরা একবার তাকিয়ে দেখি, তাহলে দেখব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য রচনা নিজের মাতৃভাষাতেই করেছিলেন। অন্যদিকে, মুন্সি প্রেম চাঁদ তিনি হিন্দিতে সাহিত্য রচনা করেছেন। কারণ হিন্দি ছিল তাঁর মাতৃভাষা। নিজের মাতৃভাষা তামিলে সাহিত্য রচনা করেছেন সুব্রহ্মণ্য ভারতী। ওড়িশার বিখ্যাত সাহিত্যিক গোপীনাথ মোহান্তি তিনিও নিজের মাতৃভাষা (International Mother Language Day) ওড়িয়াতেই সাহিত্য রচনা করেছেন। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারে পড়ুয়ারা। শুধুমাত্র তাই নয় এটি সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের সংস্কৃতিকেও শক্তিশালী করে।
ভারতীয় ভাষা পুস্তক প্রকল্প
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট পেশ করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তিনি সেই বাজেটে একটি প্রকল্প চালু করেন যার নাম দেন, ভারতীয় ভাষা পুস্তক প্রকল্প। এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য হল, স্কুল এবং কলেজের পড়ুয়াদের জন্য ভারতীয় ভাষায় বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল বই সরবরাহ করা। অর্থমন্ত্রী মনে করেন যে, এর মাধ্যমে শিক্ষা আরও সহজেই পৌঁছাতে পারবে পড়ুয়াদের কাছে। অর্থাৎ মাতৃভাষায় শিক্ষায় বিষয়বস্তু সহজেই বোধগম্য হয়। এর পাশাপাশি এটি একটি প্রজন্মকে সশক্তিকরণের পথে নিয়ে যায়।
মোদি জমানায় বাড়ছে মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব
মোদি জমানায় এমন উদ্যোগ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরাও দুহাত ভরে সমর্থন করছেন। সেরকমই একজন হলেন এম জৈন কলেজের ডিন ডঃ এমএম রানা। তিনিও মাতৃভাষায় ওপর শিক্ষাদানের এমন উদ্যোগকে প্রশংসা করেন। তাঁর মতে, ‘‘২০২৫ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে ভারতীয় ভাষা পুস্তক নামের যে প্রকল্পটি আনা হয়েছে, তা সত্যিই একটি বড় পদক্ষেপ। স্থানীয় ভাষায় ডিজিটাল বইয়ের মাধ্যমে এই প্রকল্প পড়ুয়াদেরকে আরও বেশি উন্নত করবে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পড়ার বই ইংরেজি বা হিন্দিতে হয়। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষায় এমন উদ্যোগের ফলে পড়ুয়ারা আরো ভালোভাবে পড়ার ধারণাগুলি বুঝতে পারবে এবং তারা অনেক কিছু বিশ্লেষণ করতে পারবে সহজেই।
কী বলছে সমীক্ষা?
সম্প্রতি, একটি সমীক্ষা হয়েছিল নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে। সেই সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে এই দেশগুলির ৩৭ শতাংশ পড়ুয়াকে সেই ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় না, যে ভাষাটা তারা সবচেয়ে ভালো বোঝে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুসারে ভারতের ক্ষেত্রে এটি ৩৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে বেশিরভাগই রয়েছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের। ভারতের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ অনুযায়ী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এবং যেখানে সম্ভব অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে।
করোনা অতিমারিও মাতৃভাষায় শিক্ষাকে প্রভাবিত করেছে
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন যে, করোনা অতিমারিও মাতৃভাষায় শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। ইউনেস্কোর সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে এবং সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে এই সময় বিভিন্ন স্কুলই বন্ধ ছিল। এর ফলে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার মান আরও নিচে নেমে গিয়েছে। প্রত্যেকটি স্কুলে গড়ে কমবেশি ২৪ সপ্তাহ ধরে বন্ধ ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্কুল আবার ৭০ সপ্তাহ বন্ধ ছিল এই সময়ের মধ্যে।
মাতৃভাষার কোনও বিকল্প নেই
প্রসঙ্গত বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষা ক্রমশই বহুভাষার হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষের মতো দেশে অভিভাবকরা ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। একাধিক ভাষা জেনে রাখা ভালো। কিন্তু শিক্ষাদানটা সেই বিষয়ে হওয়া উচিত যে ভাষাতে সহজে বোঝা যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইংরেজি হল বিশ্বব্যাপী একটি ভাষা। কিন্তু নিজের সংস্কৃতি, নীতি, সাহিত্য থেকে পড়ার যে কোনও জটিল তত্ত্ব বোঝার জন্য মাতৃভাষার (Mother Language) কোনও বিকল্প নেই।