মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটক ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রার (Jyoti Malhotra) কাছ থেকে ১২ টেরাবাইট ডিজিটাল তথ্য আদায় করেছে হরিয়ানার হিসার পুলিশ। এই তথ্যভাণ্ডারে রয়েছে চ্যাট রেকর্ড, কল লগ, ভিডিও ফুটেজ, আর্থিক লেনদেন এবং অন্যান্য ফরেন্সিক প্রমাণ—যা পাকিস্তানভিত্তিক চার ব্যক্তির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা স্পষ্ট করেছে। সাম্প্রতিক কালে যুদ্ধ শুধু গোলাগুলিতে হয় না। সমাজে নিজেদের মতামত স্পষ্ট করতে, মানুষকে বোকা বানাতে ব্যবহৃত সোশ্যাল মিডিয়া। এর মধ্য দিয়েই চলে ব্রেন ওয়াশ, বা মগজ ধোলাই। তদন্তে যে সমস্ত বিস্ফোরক তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে, তার ভিত্তিতে ইতিমধ্যে জ্যোতিকে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই (ISI)- এর ‘অ্যাসেট’-ও বলছেন তদন্তকারীদের একাংশ। হয়তো এই জন্যই লাহোরের আনারকলি বাজারে যখন ঘুরে বেড়াচ্ছিল জ্যোতি মালহোত্রা, তখন তার সঙ্গে ছিল অন্তত ছ’জন বন্দুকধারী। যাদের হাতে ছিল একে-৪৭। সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের এক ইউটিউবারের ভিডিওয় দেখা গিয়েছে এই চিত্র। ওই ভাইরাল ভিডিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
জ্যোতিকে ঘিরে বন্দুকধারী কেন?
বিদেশি ইউটিউবের এক ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, লাহোরের আনারকলি বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে জ্যোতি। আর তাকে নিরাপত্তা দিতে হাতে অত্যাধুনিক রাইফেল একে-৪৭ নিয়ে হাজির বেশ কয়েকজন রক্ষী। একজন ইউটিউবার, ভ্লগারের জন্য এত উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা? স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে অনেক। একজন ইউটিউবারের জন্য নিরাপত্তায় কেন এত কড়াকড়ি? বিস্মিত খোদ জ্যোতির ভিডিও করা স্কটিশ ইউটিউবারও। একজন ভারতীয় ইউটিউবার পাকিস্তানের রাস্তায় হাঁটছে। ভিডিও শ্যুট করছে। আর তাকে ঘিরে কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রেখেছে সশস্ত্র বাহিনী। অতএব পাকিস্তানের সঙ্গে জ্যোতির যোগাযোগ যে ছিল তা স্পষ্ট। ওই স্কটিশ ইউটিউবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন ওই বন্দুকধারীদের সঙ্গে রাখার প্রয়োজন হয়েছিল জ্যোতির। ওই সশস্ত্র ব্যক্তিরা রক্ষী ছিল, না কি অন্য কেউ, সেই প্রশ্নও রয়েছে। সূত্রের খবর, এই প্রশ্নগুলি ভাবাচ্ছে হরিয়ানা পুলিশকেও।
নিরাপত্তা হুমকি ও ‘ন্যারেটিভ পুশ’
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, পাকিস্তানি আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল জ্যোতির। নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানি আধিকারিক দানিশের সঙ্গে তার ‘ঘনিষ্ঠতা’ ছিল বলে অভিযোগ। দানিশকে আগেই ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছে ভারত। অভিযোগ, দানিশের মাধ্যমে পাকিস্তানের আরও আধিকারিক, এমনকি গুপ্তচরদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল জ্যোতির। তিনি পাক চরদের কী তথ্য দিয়েছে, তা এখন খতিয়ে দেখছে পুলিশ। ডিজিটাল ফরেন্সিক তদন্তে উঠে এসেছে, কীভাবে একটি সুপরিকল্পিত ‘ন্যারেটিভ পুশ’ বা মতপ্রচার কৌশলের অংশ হিসেবে জ্যোতিকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। রাষ্ট্রবিরোধী এই প্রচার কৌশলের লক্ষ্য ছিল সমাজকে বিভাজিত করা, ভুয়ো তথ্য ছড়ানো এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করা। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এমন সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবশালীদের কাজে লাগিয়ে ভারতের আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করার কৌশলে লিপ্ত।
চার পাকিস্তান বংশোদ্ভূত ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি যোগ
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে,পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত চার জন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি এবং ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল জ্যোতির। তাদের সঙ্গে জ্যোতির চ্যাটে কোনও গ্রুপ বা মধ্যস্থতাকারীর উপস্থিতি ছিল না, যা থেকে বোঝা যায়, এই কথোপকথন ছিল পুরোপুরি গোপনীয়। জানা গিয়েছে, পাকিস্তানি এই চার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পরিচয় এবং গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে সচেতন ছিল জ্যোতি। তার পাকিস্তান সফরের পরপরই তার সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলে ফলোয়ার ও ভিউয়ারশিপ হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। তদন্তকারীদের মতে, এটি শুধুমাত্র স্বাভাবিক জনপ্রিয়তা নয়, বরং পরিকল্পিত প্রচার অভিযানের অংশ, যেখানে তার পোস্ট ও ভিডিও বিশেষভাবে ‘ন্যারেটিভ পুশ’ কৌশল অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছিল। পুলিশের দাবি, জ্যোতি সচেতনভাবেই এই গোয়েন্দা জালে পা দিয়েছিল এবং সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজে থেকেই সহযোগিতা করেছিল।
বিশেষ ভিসা ও নিরাপত্তা কভার
প্রথম পাকিস্তান সফরের পর জ্যোতি মালহোত্রাকে স্পেশাল ভিসা ও নিরাপত্তা কভার দেওয়া হয়েছিল। যা সাধারণ বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য অত্যন্ত বিরল। তদন্তকারীদের ধারণা, আইএসআই তাকে ‘অ্যাসেট’ হিসেবে গড়ে তুলেছিল এবং বিশেষ এই সুবিধাগুলি তার সক্রিয় সহযোগিতার পুরস্কার ছিল। স্কটল্যান্ডের ওই ইউটিউবারের ভিডিওতে দেখা যায় জ্যোতিকে যারা পাহাড়া দিচ্ছিল, তাদের গায়ে যে জ্যাকেট ছিল, তাতে লেখা ‘ভয় নেই’। ভিডিওতে স্কটিশ ইউটিউবার একবার জ্যোতিকে জিজ্ঞাসা করেছেন পাকিস্তানের আতিথেয়তা প্রসঙ্গে। স্পষ্ট ভাষায় জ্যোতি জানিয়েছে পাকিস্তানের আতিথেয়তা দারুণ। তার মুখভঙ্গিই বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে কতটা খুশি পাকিস্তানের আতিথেয়তায়। আপাতত জ্যোতির মোবাইল এবং ল্যাপটপ, আর সেখানে পাওয়া ছবি, ভিডিও খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী আধিকারিকরা। পাকিস্তানের সঙ্গে জ্যোতির যোগাযোগ কতটা দৃঢ়, কী কী তথ্য তার মাধ্যমে পাচার হয়ে গিয়েছে তা জানার চেষ্টা চালাচ্ছেন তদন্তকারীরা। আর কে কে এই গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত, তাদের খোঁজও চলছে।
শক্তিশালী ডিজিটাল প্রমাণ, হতে পারে সাজা
পুলিশ সূত্রে খবর, জ্যোতির কাছ থেকে পাওয়া ডিজিটাল প্রমাণ এতটাই শক্তিশালী যে, এর ভিত্তিতে আদালতে সহজে দোষ স্বীকার করানো সম্ভব হতে পারে। যদিও এখনও কোনও সংবেদনশীল তথ্য ফাঁসের প্রমাণ মেলেনি, তবুও তার কাজকর্ম সাধারণ সাংবাদিকতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে মত তদন্তকারীদের। জ্যোতির কাছ থেকে প্রাপ্ত ডেটা বিশ্লেষণে বেশ কিছু আর্থিক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে। এই ঘটনা আবারও তুলে ধরছে কীভাবে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তার করছে এবং ভেতর থেকে দুর্বল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।