মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: দিনটা ছিল ২ মে, ২০২১। আজ থেকে চার বছর আগে সপ্তদশ বিধানসভার নির্বাচনী ফল ঘোষণা হয়েছিল। দুপর ১ টার মধ্যেই নির্বাচনী ফলে স্পষ্ট হয় যে পশ্চিমবঙ্গে টানা তৃতীয়বারের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরবে। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর কাছে (Post Poll Violence) পরাজিত হয়েছিলেন। শাসক দলের নেতা-কর্মীরা “ঠিক ঠিক খেলা হবে এই মাটিতেই খেলা হবে” গান বাজিয়ে হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করে দেয়। এরপর শুরু হয় রাজ্যজুড়ে শাসকদলের দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য এবং হিংসালীলা (West Bengal)। বিজয় মিছিলের নামে বিজেপি কর্মী, আরএসএসের স্বয়ংসেবক এবং সাধারণ নিচুতলার হিন্দুদের টার্গেট করে শুরু হয় প্রশাসনিক মদতে সন্ত্রাস। তৃণমূলের স্লোগান ছিল ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’, জয় নিশ্চিত বুঝেই নিজের মেয়ে মমতার হাতেই হিন্দু বাঙালিদের চরম অত্যাচারের শিকার হতে হয়। টানা হিংসায় মে মাসেই খুন করা হয় ২২ জনের বেশি মানুষকে।
বিজেপি কর্মীর বাড়িতে হামলা
দুপুর ২ টোর মধ্যেই কাঁকুড়গাছি রেলকলোনিতে বিজেপি কর্মী অভিজিৎ সরকারের বাড়িতে হামলা করে ২০০ জনেরও বেশি তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী। বাড়িতে নিজের মা-দাদার সামনেই পাথর দিয়ে থেঁতলে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। বাড়িতে গৃহপালিত কুকুরগুলির গলায় ইলেকট্রিক তার জড়িয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। মুড়িমুড়কির মতো বোমা মেরে গোটা বাড়ি তছনছ করে দেয় দুষ্কৃতীরা। এরপর শুরু হয় দেদার লুটপাট। মৃত্যুর পর ৪ বছর কেটে গেলও, হাইকোর্টে মামলা চলছে। কিন্তু দোষীরা এখনও সাজা পায়নি। শাসক দলের নেতা বলে দোষীদের টিকিও ছুঁতে পারেননি তদন্তকারী অফিসাররা।
শাসক দলের দুষ্কৃতীদের উল্লাস
তখন রাত ৮টা। নির্বাচনী ফল ঘোষণার পর শাসক দলের দুষ্কৃতীদের উল্লাসে গোটা গ্রাম আতঙ্কে ভয়ে সিটিয়ে গিয়েছিল। কৃষ্ণনগর শহরের কাছেই বাড়ি ছিল পলাশ মণ্ডলের। পেশায় দিন মজুর ছিলেন। প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধার কাজ করে কোনও রকমে সংসার চালাতেন। নির্বাচন চলাকালীন মমতার দুর্নীতি এবং কর্মসংস্থান নেই বলে বিক্ষোভ সভায় বিজেপি মঞ্চের বাঁশ বেঁধেছিলেন তিনি। এলাকায় বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য লিফলেটও বিলি করেছিলেন। ফল প্রকাশের আগেও হুমকি দিয়েছিল এলাকার তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। হুমকি উপেক্ষা করে তবুও বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার দিনে রাত ১১ টায় বাড়িতে বড় বড় দা, তলোয়ার নিয়ে হামলা করে কয়েকশো তৃণমূল কর্মী। ভয়ে পলাশ নিজের বউ আর দুই মেয়েকে নিয়ে চৌকির নিচে লুকিয়ে পড়েন। ঘরের টিন কেটে দুর্বৃত্তরা ঢুকে নীচ থেকে মারতে মারতে পলাশকে টেনে হিঁচড়ে বের করে (West Bengal)। এরপর শুরু হয় ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে এলোপাথাড়ি কোপ। শেষে যাওয়ার সময় কানের কাছে মাথায় গুলি করে যায় হত্যাকারীরা। সব কিছু শেষ হয়ে যায়! পরিবারে একমাত্র রোজগার করতেন পলাশ। কীভাবে চলছে পলাশের ফেলে যাওয়া সংসার জানেন? স্ত্রী এখন লোকের বাড়িতে কাজ করে কোনও রকমে সংসার চালান। আর ভয়-আতঙ্কে এখনও নিজের বাড়িতে ঢুকতে ভয় পান (Post Poll Violence)।
৭১ জনকে হত্যা
ওই বছর ২ মে থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে মোট ৭১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তালিকায় কোনও জেলা বাদ ছিল না। তৃণমূলের লাগাম ছাড়া অত্যচারে ১ লক্ষ মানুষ নিজের বাড়ি-ঘর ঘরছাড়া হয়েছিল। মানুষ বাংলা ছেড়ে অসম, ঝাড়খণ্ডে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। ৪০ হাজার মানুষের বাসস্থানকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সওকত মোল্লা, শেখ শাহজানের নেতৃত্বে তৃণমূলী গুণ্ডারা হিন্দুদের দোকান, বাড়ি, ফসলের ক্ষেতে বুলডোজার চালিয়ে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। নন্দীগ্রামে এক মহিলা শুধুমাত্র হিন্দু বলে ধর্ষণ করা হয়। অত্যাচারের মাত্রা লাগাম ছাড়া ছিল দুই ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, বীরভূম এবং কোচবিহার জেলায়। দোষীদের একজনেরও সাজা হয়নি। দেখে নিন জেলা ভিত্তিক মৃতদের তালিকা –
ভোটপরবর্তী হিংসায় মৃতের নাম, স্থান এবং তারিখ
বাঁকুড়া (৩ জন)
১। অরূপ রুইদাস, ইন্দাস, ৩ মে ২০২১
২। কুশ ক্ষেত্রপাল, কোতলপুর, ৮ মে ২০২১
৩। গৌর দাস, বিষ্ণুপুর, ১৬ মে ২০২১
বীরভূম (৫ জন) (Post Poll Violence)
৪। গৌরব সরকার, বোলপুর, ২ এপ্রিল ২০২১
৫। জাকির হোসেন, ময়ূরেশ্বের, ৮ মে ২০২১
৬। প্রসেঞ্জিৎ দাস, রামপুরহাট, ২৩ মে ২০২১
৭। মনোজ জসওয়াল, নলহাটি, ৬ মে ২০২১
৮। মিঠুন বাগদি, ১৪ জুন ২০২১
কোচবিহার (১৪ জন) (West Bengal)
৯। মিঠুন বর্মণ, শীতলকুচি, ২৭ মার্চ ২০২১
১০। মানিক মৈত্র, শীতলকুচি, ৩ মার্চ ২০২১
১১। হারাধন রায়, দিনহাটা, ৪ মার্চ ২০২১
১২। ধীরেন বর্মণ, শীতলকুচি, ২৪ মে ২০২১
১২। অলোকলতা মণ্ডল, তফানগঞ্জ, ২৫ মে ২০২১
১৪। অনিল বর্মণ, শীতলকুচি, ২৯ মে ২০২১
১৫। শ্রীধর দাস, দিনহাটা, ২৩ জুন ২০২১
১৬। আনন্দ বর্মণ, শীতলকুচি, ২৭ মার্চ ২০২১
১৭। রবিন বর্মণ, শীতলকুচি, ৪ মে ২০২১
১৮। বিশ্ব বর্মণ, শীতলকুচি, ৩ মে ২০২১
১৯। বিপুল রায়, শীতলকুচি, ৩ মে ২০২১
২০। বিকাশ চন্দ্র বর্মণ, শীতলকুচি, ৩ মে ২০২১
২১। বীরেন্দ্রনাথ রায়, শীতলকুচি, ৩ মে ২০২১
২২। ফারুখ মণ্ডল, তুফানগঞ্জ, ৪ মে ২০২১
হুগলি (২ জন)
২৩। রবি হরি, আরামবাগ, ৪ জুন ২০২১
২৪। সুকুমার মণ্ডল, কৃষ্ণরামপুর, ৭ মে ২০২১
হাওড়া (১ জন)
২৫। গুড্ডু চৌরাসিয়া, শিবপুর, ১০ মে ২০২১
জলপাইগুড়ি (১ জন)
২৬। সুশান্ত রায়, জলপাইগুড়ি, ২ মে ২০২১
ঝাড়গ্রাম (২ জন)
২৭। কিশোর মান্ডি, বিনপুর, ৫ মে ২০২১
২৮। তারক সাহু, ঝাড়গ্রাম, ৩১ মার্চ ২০২১
কলকাতা (২ জন)
২৯। অভিজিৎ সরকার, কাঁকুড়গাছি, ২ মে ২০২১
৩০। নাম পাওয়া যায়নি, অন্বেষা বেরা অভিযোগ করেছেন।
মালদা (৩ জন)
৩১। মনোজ মণ্ডল, মোথাবাড়ি, ৩ মে ২০২১
৩২। চৈতন্য মণ্ডল, মোথাবাড়ি, ৩ মে ২০২১
৩৩। দেবাশিস সরকার, গাজোল, ২ মে ২০২১
নদিয়া (৫ জন)
৩৪। উত্তম ঘোষ, চাকদা, ২ মে ২০২১
৩৫। ধর্ম মণ্ডল, চাপড়া, ৬ মে ২০২১
৩৬। সাগর মাঝি, চাকদা, ২ মে ২০২১
৩৭। দিলীপ কীর্তনিয়া
৩৮। পলাশ মণ্ডল, কৃষ্ণনগর, ১৩ মে ২০২১
উত্তর ২৪ পরগনা (১৩ জন)
৩৯। শোভারানী মণ্ডল, জগদ্দল, ৩ মে ২০২১
৪০। হারান অধিকারী, সোনারপুর, ২ মে ২০২১
৪১। আকাশ যাদব, ভাটপাড়া, ২ মে ২০২১
৪২। সন্তু মণ্ডল, নৈহাটি, ৩ মে ২০২১
৪৩। জ্যোৎস্না মল্লিক, বারাসাত, ১২ মে ২০২১
৪৪। রোহিত প্রকাশ যাদব, ভাটপাড়া, ৬ জুন ২০২১
৪৫। রোহিত প্রকাশ, ভাটপাড়া, ০৬ জুন ২০২১
৪৬। শিবনাথ বারুই, হিংলগঞ্জ, ৫ মে ২০২১
৪৭। জয়দেব মিস্ত্রি, হিংলগঞ্জ, ৫ মে ২০২১
৪৮। বিক্রম ঢালি, মিনাখাঁ, ৬ মে ২০২১
৪৯। জয়প্রকাশ যাদব, ভাটপাড়া, ৬ মে ২০২১
৫০। প্রসেঞ্জিত দাস, বাগুইহাটি, ২৩ মে ২০২১
৫১। রঞ্জিত দাস, আমডাঙ্গা, ১৩ মে ২০২১
পশ্চিম মেদিনীপুর (১ জন)
৫২। বিশ্বজিত মাহেশ, স্বয়ং, ৪ মে ২০২১
পূর্ব বর্ধমান (৬ জন)
৫৩। বলরাম মাঝি, কেতুগ্রাম, ৫ মে ২০২১
৫৪। কাকলি ক্ষেত্রপাল, জামালপুর, ৩ মে ২০২১
৫৫। নারায়ণ দে, বর্ধমান, ৬ মে ২০২১
৫৬। দুর্গা বালা, রাইনা, ৩ মে ২০২১
৫৭। বাবুল দাস, রাইনা, ৮ মে ২০২১
৫৮। সোম হাঁসদা, ভাতার, ২৩ জুন ২০২১
পূর্ব মেদিনীপুর (২ জন)
৫৯। দেবব্রত মাইতি, নন্দীগ্রাম, ১৩ মে ২০২১
৬০। দেবাশিস শীল, তমলুক, ২৩ মে ২০২১
দক্ষিণ ২৪ পরগনা (১১ জন)
৬১। সৌরভ বর, মথুরাপুর, ২ মে ২০২১
৬২। রাঞ্জিত দাস, আমডাঙ্গা, ১৩ মে ২০২১
৬৩। অরিন্দম মিদ্দে, ডায়মন্ড হারবার, ১৫ মে ২০২১
৬৪। প্রদীপ বৈদ্য, বাসন্তী, ১৮ মে ২০২১
৬৫। নির্মল মণ্ডল, সোনারপুর, ২০ মে ২০২১
৬৬। রাজু সামন্ত, ডায়মন্ড হারবার, ২৮ মে ২০২১
৬৭। চন্দন হালদার, সাতগাঁছি, ২ জুলাই ২০২১
৬৮। ঊষা দাস, বজবজ, ৬ জুলাই, ২০২১
৬৯। হারান অধিকারী, সোনারপুর, ২ মে ২০২১
৭০। মানস সাহা, মগরাহাট, ২২ সেপ্টম্বর ২০২১
৭১। মিঠুন ঘোষ, রায়গঞ্জ, ১৮ অক্টোবর ২০২১
এই সন্ত্রাসে পুলিশের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নিষ্ক্রিয় (Post Poll Violence)। তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি সত্ত্বেও হিংসা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। সরকারের উপর চাপ তৈরি করেছিলেন। মানবাধিকার কমিশন, মহিলা ও শিশু সুরক্ষা কমিশন, এসসি-এসটি কমিশন-সহ একাধিক সংস্থা হিংসা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে (West Bengal)। পুলিশ প্রাথমিক ভাবে থানায় অভিযোগ বা মামলা গ্রহণ করেনি। নির্যাতিতরা অগত্যা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিলেন। হাইকোর্টের নির্দেশে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইমেল-এর মাধ্যমে অভিযোগ নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে হাইকোর্টের বিচারপতি রাজেশ বিন্দেলের রায়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংন্থা এবং সিট গঠন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদন্ত এখনও চলছে, রাজ্য সরকার হিংসায় ক্ষতিগ্রস্তদের কোনও রকম আর্থিক সহযোগিতাও করেনি। উল্লেখ্য, অভিযুক্তরা এখনও উন্মুক্ত এবং এলাকায় ভয়ের পরিবেশ বজায় রাখতে সক্ষম। এই হিংসার পর থেকেই পরবর্তী পঞ্চায়েত নির্বাচন, পুরসভার নির্বাচন এবং লোকসভার ভোটের পরও ভোট পরবর্তী হিংসা একটি অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের (West Bengal) রাজনীতিকরণ ১০০ শতাংশ সার্থক হয়েছে। এ রাজ্যে ভোটের অর্থ হল হিংসা, ধর্ষণ, খুন, অত্যাচার আর লুটপাট। রাজনীতিতে অত্যাচার এবং হিংসা কবে বন্ধ হবে তাও এই রাজ্যের মানুষের কাছে একটি বড় প্রশ্ন (Post Poll Violence)।