মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: কাঠ পাচারের অর্থ দিয়ে চলত সন্ত্রাস (Terror-Funding Network)। কেনা হত অবৈধ অস্ত্র। মধ্যপ্রদেশের (Bhopal) আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে অবৈধ কাঠ পাচারের একটি সাধারণ মামলার তদন্তে উঠে এল এমনই ভয়ঙ্কর তথ্য। তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মধ্যপ্রদেশের আলিরাজপুর জেলা। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ED), ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (NIA), রাজ্য এটিএস এবং একাধিক রাজ্যের বন দফতর এই জেলায় কাঠ পাচারের তদন্তে নেমেছে। দেখা গিয়েছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বন লুণ্ঠনের অর্থ সন্ত্রাসে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়েও।
২০০ কোটি টাকার খৈর কাঠ সাম্রাজ্য
তদন্তকারী সংস্থাগুলির দাবি, গুজরাটের গোধরার বাসিন্দা মোহন তাহির গত তিন বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার খৈর (কাঠা) কাঠ অবৈধভাবে কেটে পাচার করেছেন। বাজারমূল্য অনুযায়ী, খৈরের ব্যাপক ব্যবহার (কাঠা উৎপাদনে) বিবেচনায় এই অঙ্ক ৭০০ কোটি টাকাতেও পৌঁছতে পারে। অভিযোগ অনুযায়ী, আলিরাজপুরের মালওয়াই গ্রামে ব্যক্তিগত জমিতে ‘শালিমার এন্টারপ্রাইজেস’-এর নামে একটি গোপন কাঠের ডিপো চালাতেন তাহির। ডিপোর দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন আরিফ (আলিফ) আলি মাকরানি, যাঁকে ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জুন মাসে গুজরাটে একটি ট্রাক অবৈধ খৈর কাঠসহ আটক হওয়ার পর এই চক্রের হদিশ মেলে। জেরায় চালক জানায়, কাঠটি আলিরাজপুরের একটি ডিপোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এই তথ্যের ভিত্তিতে সুরাটের মাণ্ডভি ফরেস্ট ডিভিশনের নেতৃত্বে যৌথ অভিযান চালিয়ে আলিরাজপুরের ডিপোটি সিল করে তদন্তকারী অফিসাররা।
বৈধ ব্যবসার আড়ালে চোরাচালান
বন দফতর পরে জানায়, ওই অঞ্চল থেকে প্রায় ১,৬০০ ঘনমিটার বা ২,০০০ মেট্রিক টনের বেশি খৈর কাঠ উদ্ধার হয়েছে, যা বৈধ ব্যবসার আড়ালে মজুত করা ছিল। মাণ্ডভি (সুরাট) বন বিভাগের আধিকারিক এইচ আর যাদব বলেন, “২০২৪ সালের জুলাইয়ে আমরা মামলা দায়ের করি। আলিরাজপুরের শালিমার এন্টারপ্রাইজেসে যাওয়ার পথে একটি ট্রাক আটক করা হয়। তদন্তে দেখা যায়, এই চক্র গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা হয়ে হরিয়ানা ও দিল্লি পর্যন্ত সক্রিয় ছিল এবং প্রায় দুই বছর ধরে চলছিল।”
কাঠ থেকে সন্ত্রাস: তদন্তের ভয়াবহ মোড়
তদন্ত আরও ভয়ঙ্কর মোড় নেয়, যখন কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি আলিরাজপুর ডিপোর সঙ্গে উগ্রপন্থী নেটওয়ার্কের যোগসূত্র খুঁজে পায়। রাজ্য এটিএস-এর এক শীর্ষ কর্তা জানান, “আলিরাজপুরের ডিপো ও খৈর কাঠের মজুতের সঙ্গে আইএসআইএস-প্রভাবিত পদঘা মডিউলের যোগ মিলেছে। অবৈধ কাঠ ব্যবসা থেকে পাওয়া অর্থ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছিল। ডিপো পরিচালনাকারীদের সঙ্গে সাকিব নাচানের যোগসূত্রও সামনে এসেছে।” ২০২৫ সালের ১১ ডিসেম্বর, ইডি মহারাষ্ট্র, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, গুজরাট, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে মোট ৪০টি জায়গায় অভিযান চালায়। পিএমএলএ আইনের আওতায় চালানো এই অভিযানে উদ্ধার হয় ৯.৭০ কোটি টাকা নগদ, ৬.৬ কোটি টাকার সোনা ও গয়না, ২৫টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয় এবং হাওয়ালা নথি, ডিজিটাল ডিভাইস বাজেয়াপ্ত করা হয়। মেলে উগ্রপন্থার সঙ্গে জড়িত নানা নথিও। ইডি জানিয়েছে, গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছিল যে হাওয়ালা, অবৈধ গবাদি পশু পাচার এবং খৈর কাঠ ব্যবসা থেকে আয় করা অর্থ চরমপন্থী কার্যকলাপে ব্যবহৃত হচ্ছিল। ইডি অভিযানে চিহ্নিত অভিযুক্ত সচিন ফাকলে ও খলিল উসমান মুল্লার নাম আলিরাজপুর খৈর কাঠ মামলাতেও রয়েছে, যা সন্ত্রাস-অর্থায়নের অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে। এনআইএ-র দাবি অবৈধ কাঠ পাচারের টাকা জঙ্গি নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংগ্রহে ব্যবহৃত হতো।
মূল অভিযুক্ত পলাতক
আদালতের নির্দেশে ডিপো ডি-সিল করার সময় গুজরাটের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি ড. মহেন্দ্র সিং কচ্ছাওয়া জানান, “ডিপোর মালিক মোহন তাহির পলাতক। ইমিগ্রেশন রেকর্ড অনুযায়ী তিনি হজ করতে দেশ ছেড়েছেন এবং ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ফেরেননি। অবৈধ খৈর কাঠ ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থ দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, ডিপো ম্যানেজারের সঙ্গে যুক্ত হাওয়ালা লেনদেনের তথ্য ইডি-কে দেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রতি ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রায় ৪ কোটি টাকার লেনদেনের হদিশ মিলেছে।
একাধিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন
তদন্তকারীরা জানান, ২০২১ সালের পর মধ্যপ্রদেশে খৈরকে সংরক্ষিত প্রজাতির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়, ফলে পরিবহণ ও মজুতের নিয়ম শিথিল হয়। তবে প্রশ্ন উঠছে—গুজরাটে কাটা খৈর কাঠ কেন আলিরাজপুরে এনে মজুত করা হলো? শাল ও সেগুনের জন্য পরিচিত একটি ডিপোতে কেন শুধুই খৈর কাঠ ছিল? বন দপ্তরের কেউ কি জড়িত ছিলেন, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে নীরবতা পালন করা হয়েছিল? ড. কচ্ছাওয়া স্পষ্ট করে বলেন, “যদি কোনো বন কর্মকর্তা জড়িত থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” একাধিক সংস্থা—বন দফতর, পুলিশ, এটিএস, ইডি ও এনআইএ—তদন্তে নেমেছে। আলিরাজপুরের খৈর কাঠ কেলেঙ্কারি এখন আর শুধু অবৈধ লগিংয়ের মামলা নয়; এটি হয়ে উঠেছে এমন এক ভয়াবহ প্রশ্ন, যেখানে বন লুণ্ঠনের অর্থ সন্ত্রাসে ব্যবহৃত হয়েছে কি না, এবং বছরের পর বছর ধরে কীভাবে একটি ২০০ কোটি টাকার ছায়া অর্থনীতি নীরবতার সুযোগে বেড়ে উঠল—তার উত্তর খোঁজা হচ্ছে।
