সুশান্ত দাস: বেশ কিছুদিন ধরেই একাধিক দেশীয় সংবাদমাধ্যমে খবর ভেসে আসছে যে, চিনের আগ্রাসী মনোভাবের মোকাবিলা করতে নিকট ভবিষ্যতে রাশিয়া থেকে ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বার’ কিনতে বা লিজ় নিতে চলেছে ভারত। একটা বা দুটো নয়, জানা যাচ্ছে, একেবারে ৬টি টুপোলেভ টিইউ-১৬০ (Tupolev TU-160) বোমারু যুদ্ধবিমান নিতে পারে ভারত। তেমনটা হলে, এই প্রথম কোনও ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বার’ ভারতের কাছে আসবে।
কিন্তু, এই প্রসঙ্গে মনের মধ্যে একাধিক প্রশ্ন উঠছে, যা স্বাভাবিক। প্রথমত, হঠাৎ এমন বিশেষজ্ঞ বোমারু বিমানের প্রয়োজনীয়তা কেন উঠল? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বর্তমান যুগে বোমারু বিমানের তাৎপর্য কোথায়? তৃতীয়ত, ভারত রাশিয়া থেকে কেনা বিমানের যন্ত্রাংশ নিয়ে অতীতে ভুগতে হয়েছে ভারতকে। এর পরও এই বিমানের গ্রহণযোগ্যতা কতটা? চতুর্থ, এই বিমানের এমন কী মাহাত্ম্য যে, ভারত তা কিনতে তৎপর হয়ে পড়েছে বলে খবর।
এই সব প্রশ্নের বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে, জেনে নেওয়া যাক স্ট্র্যাটেজিক বম্বার ঠিক কী? বোমারু বিমান দুই প্রকারের হয়। একটি স্ট্র্যাটেজিক ও দ্বিতীয়টি ট্যাক্টিক্যাল। সহজ সরল ভাষায়, স্ট্র্যাটেজিক বম্বার হল বিশেষজ্ঞ বোমারু বিমান। এগুলো সাধারণত দূরপাল্লা পাড়ি দিতে পারে। বিশাল পরিমাণে এবং পরমাণু সহ বিভিন্ন ধরণের মারণাস্ত্র বহনে সক্ষম। এরা মূলত শত্রুদেশের একেবারে ভেতরে ঢুকে সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত লক্ষ্য বা পরিভাষায় স্ট্র্যাটেজিক টার্গেট ধ্বংস করে বেরিয়ে আসতে পারে। এই বিমান শত্রুর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন— রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক ঘাঁটি উড়িয়ে দিতে পারদর্শী।
‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বার’-এর প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব প্রথম টের পাওয়া গিয়েছিল সাবেকি সোভিয়েত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থাকা ঠান্ডা যুদ্ধের সময়। দুপক্ষই সেই সময় পরমাণু অস্ত্র বহনের জন্য ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বার’-এর ব্যবহার করেছিল। বর্তমান যুগে, শক্তশালী দেশগুলোর হাতে আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র চলে এসেছে। যুদ্ধবিমানগুলো মাঝ-আকাশে জ্বালানি ভরতে সক্ষম হওয়ায়, তারাও দূরে পাড়ি দিতে পারছে। ফলে, এই পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে এই স্ট্র্যাটেজিক বম্বারের প্রয়োজনীতা ফুরিয়ে আসছে।
তবে, একইসঙ্গে এও বলে রাখা দরকার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বার’ হয়ত সেরা অস্ত্র নয়। তবে তা শক্তিশালী অস্ত্র, এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শত্রু দেশের সীমান্তের কাছে যতই ক্ষেপণাস্ত্র বা পরমাণু অস্ত্রবহনে সক্ষম সাবমেরিন মোতায়েন করা হোক না কেন, সীমান্তের কাছে যদি ‘স্ট্র্যাটেজিক বম্বার’ ঘোরাফেরা করে, তাহলে তার তাৎপর্য অন্য পর্যায়ে চলে যায়। সেটা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই বলেই মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
এবার প্রশ্ন, ভারত কেন এই বিমানে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে বলে শোনা যাচ্ছে? চিনের কাছে তাদের নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক বম্বার ‘শিয়ান এইচ-এস ৬কে’ (Xian HS-6K) রয়েছে। ভারতীয় সেনা জানতে পেরেছে, সীমান্তের কাছে এই বোমারু বিমান মোতায়েন করেছে চিনা বায়ুসেনা (PLAAF)। এতে ভারতের উদ্বেগ বেড়েছে। কাজেই ভারতের হাতে এই রুশ স্ট্র্যাটেজিক বম্বারগুলো এলে চিনা আগ্রাসী মনোভাবের যথোপযুক্ত জবাব দেওয়া যাবে বলে বিশ্বাস ওয়াকিবহাল মহলের।
কিন্তু, কেন রুশ বোমারু বিমান কেনার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে ভারত? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গেলে আগে জানা দরকার টুপোলেভ টিইউ-১৬০ বিমানের সম্পর্কে। জানতে হবে, কতটা শক্তিশালী এই বিমান। বর্তমানে বিশ্বের তিনটি দেশের কাছে নিজ নিজ স্ট্র্যাটেজিক বম্বার রয়েছে। এরা হল— আমেরিকা, চিন ও রাশিয়া। যারা শত্রুর সীমায় ঢুকে সেখানে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ধ্বংস করতে সক্ষম।
টুপোলেভ টিইউ-১৬০ এখন বিশ্বের বৃহত্তম এবং একমাত্র সুপারসনিক স্ট্র্যাটেজিক বম্বার। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২২০০ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে টিইউ-১৬০ বোমারু বিমানটি। শব্দের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে উড়তে সক্ষম এই বিমানটি। এর সার্ভিস সিলিং ১৫ হাজার। অর্থাৎ, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার মিটার উচ্চতায় উড়তে সক্ষম এই বোমারু বিমান। বিশ্বে একমাত্র মার্কিন ‘বি-২ স্পিরিট’ স্টেলথ বম্বার (B-2 Spirit stealth Bomber) প্রযুক্তিগতভাবে এই বিমানের চেয়ে উন্নত। তবে, মার্কিন বিমান শব্দের গতির চেয়ে ধীরে চলে। অর্থাৎ, সেটি সাব-সনিক।
জানা গিয়েছে, যে কোনও পরিস্থিতি এবং যে কোনও ভৌগোলিক অবস্থানে উড়তে পারে টুপোলেভ টিইউ-১৬০। বিশ্বে রাশিয়ার এই বম্বার বিমানটি ‘হোয়াইট সোয়ান’ নামেই প্রসিদ্ধ। ন্যাটো এই বিমানগুলোর সাংকেতিক নাম দিয়েছে ‘ব্ল্যাকজ্যাক’। বিমানটি একটানা ১২,৩০০ কিলোমিটার উড়তে পারে। সব মিলিয়ে ৪০ টন অস্ত্র বইতেও সক্ষম এগুলি। এটি সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কার্পেট বম্বিং করতে পারে।
সূত্রের খবর, ভারত এই বোমারু বিমানের সর্বাধুনিক ভেরিয়েন্ট ‘টিইউ-১৬০এম’ (TU-160M) সংস্করণ নিয়ে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। রাশিয়ার দাবি, টিইউ-১৬০ বিমানের তুলনায় টিইউ-১৬০এম মডেলে ৮০ শতাংশ আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন উন্নত ইঞ্জিন, টার্গেটিং সিস্টেম, উন্নত ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট। এছাড়া, বিমানের রেডার ক্রস-সেকশনও কমানো হয়েছে। প্রথাগত ও পরমাণু অস্ত্র ছাড়াও, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম বিমানের নতুন সংস্করণ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, স্ট্র্যাটেজিক বম্বার কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, তা কতটা যুক্তসঙ্গত হবে? এই মুহূর্তে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হলেও ভারতীয় বায়ুসেনার অস্ত্রাগারে বর্তমানে কোনও সুপারসনিক বোমারু বিমান নেই। অন্যদিকে চিনের হাতে রয়েছে শিয়ান এইচ-এস ৬কে স্ট্র্যাটেজিক বম্বার। কাজেই এই বিমানগুলি ভারতের হাতে এলে দেশের সামরিক শক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য যদি হয় ড্রাগনের চোখে চোখ রেখে জবাব দেওয়া, তাহলে এই বিমান প্রয়োজন। কারণ, এই বিমান ভারতের কাছে থাকলে, চিন ভারতকে সমঝে চলতে বাধ্য। যে কোনও হঠকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাবতে বাধ্য হবে চিন।
কিন্তু, কেন রুশ বিমান কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে চলেছে ভারত? রাশিয়া থেকে টিইউ-১৬০ বোমারু বিমান কেনার পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি রয়েছে। একপক্ষের মতে, এই বিমানগুলি অতীতের কোল্ড-ওয়ার সময়ের একটি স্মৃতিচিহ্ন। এই বিমান কিনলে সামরিক সক্ষমতার দিক দিয়ে ভারতের কোনও লাভের লাভ হবে না। কারণ, এই বিমানের রেডার সিগনেচার (শত্রুর রেডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা) অনেকটাই। সমালোচকদের আরও যুক্তি যে, এই দৈত্যাকার বিমানগুলি কেনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বিস্তর। তৃতীয়ত, এই বিমানের স্পেয়ার পার্টস বা যন্ত্রাংশ রাশিয়া থেকে পেতে কালঘাম ছুটে যাবে।
কিন্তু, অপর পক্ষের মতে, ভারতের হাতে এলে রণকৌশলগত সম্পদ হয়ে উঠতে পারে টিইউ-১৬০। কারণ, ভারতের আকাশপথে অভিযানের ক্ষমতা ও সক্ষমতা দুই-ই এই বিমানের ফলে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। বিশেষ করে, ভারতের এই জায়গায় একটা বড় খামতি রয়েছে। টিইউ-১৬০ স্ট্র্যাটেজিক বম্বার সেই জায়গা পূরণ করতে সক্ষম।
এখন দেখার, কোন যুক্তি শেষে গিয়ে জেতে।
+ There are no comments
Add yours