মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: রাতভর সেনা অভিযানের পর ২৭ জঙ্গিকে নিকেশ করে মোট ১৫০ পণবন্দিকে উদ্ধার করেছে পাক সেনা। এখনও বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মির (Balochistan Liberation Army) হাতে হাইজ্যাক (Pakistan Train Hijack) হওয়া জাফর এক্সপ্রেসে (Jaffar Express) আটকে বহু যাত্রী। সূত্রের খবর, অপহৃত ট্রেন থেকে যাত্রীদের মুক্ত করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষ বাঁধে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর। এর ফলে নিহত হয়েছেন ২০ জন সেনাও।
রাতভর উদ্ধার অভিযান
মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে কাচ্চি বোলান জেলার পেহরো কুনরি এবং গাদালার মধ্যবর্তী এলাকায় আটকে দেয় স্বাধীনতাপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী বিএলএ (Balochistan Liberation Army)। ট্রেনটিতে প্রায় ৫০০ জন যাত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুই শতাধিক যাত্রীকে পণবন্দি করা হয়। ঘটনার দায় স্বীকার করে বিদ্রোহীরা বিবৃতি দিয়ে জানায়, যাত্রীদের মুক্তির শর্ত হিসেবে তাদের রাজনৈতিক দাবি মানতে হবে। খবর পেয়েই পাকিস্তানের সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। অভিযানে অংশ নেয় স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ-এর কমান্ডো বাহিনীও। বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পরই অভিযানে নামে পাক সেনা। রাতভর চলে অভিযান। কিন্তু এখনও পুরোপুরি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি পাক সেনা।
বিদ্রোহীদের রণকৌশল
পাক সেনাবাহিনীকে রুখতে রেললাইনের একাংশ উড়িয়ে দেয় জঙ্গিরা। উড়ন্ত ড্রোনকেও গুলি করে নামানো হয়। শুরু হয় দু’পক্ষের গুলির লড়াই। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর বুধবার সকালে সেনা বাহিনী অন্তত ১৫০ জন যাত্রীকে মুক্ত করেছে বলে খবর। উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্যে ৫৮ জন পুরুষ, ৩১ জন নারী এবং ১৫ জন শিশু রয়েছে। আহত অন্তত ১৭ জনকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য বিদ্রোহীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে পাক সেনার দাবি, অভিযানে ২৭ জন বিদ্রোহী নিহত হয়েছে এবং বাকিদের খুঁজে বের করতে এখনও অভিযান চলছে। এখনও পণবন্দি যাত্রীদের কী হবে, তা নিয়ে আতঙ্ক নেমে এসেছে পাকিস্তানে। পণবন্দিদের মধ্যে মহিলা, শিশু ও অসুস্থদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, বলে দাবি বালোচ জঙ্গিদের। তাদের দাবি, মূলত পাকিস্তান সেনা, পুলিশ, গুপ্তচর সংস্থার সক্রিয় কর্মীরাই পণবন্দি হিসেবে রয়েছেন।
বালোচ লিবারেশন আর্মি
পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বালুচিস্তান প্রাকৃতিক ভাবে সবচেয়ে সম্পদশালী। কিন্তু ধীরে ধীরে তা বেহাত হয়ে যাচ্ছে বালোচ নাগরিকদের। ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ (সিপিইসি) তৈরির পরে গত কয়েক বছরে সেই লুট আরও বেড়েছে। ওই রাস্তা ব্যবহার করেই ইসলামাবাদ এবং বেজিংয়ের শাসকেরা বালুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করছে বলে বিএলএ, ‘বালোচ ন্যাশনালিস্ট আর্মি’ (বিএনএ)-র মতো স্বাধীনতাপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির অভিযোগ। প্রতিবাদ দমন করতে পাক সেনা এবং ফ্রন্টিয়ার কোর বাহিনী সেখানে ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ।
বালোচ লিবারেশন আর্মির লক্ষ্য
বালোচ লিবারেশন আর্মির (Balochistan Liberation Army) মূল দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে, পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে পৃথক বালোচিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই অঞ্চল। এই এলাকা আফগানিস্তানের দক্ষিণ ও পশ্চিম ইরানের সীমান্ত ঘেঁষা। গত কয়েক দশক ধরেই পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালিয়ে আসছেন এই অঞ্চলের বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, গ্যাস ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ বালোচিস্তান শোষণ করছে পাকিস্তান। অথচ, এই খনিজ সম্পদের কোনও সুবিধা এখানকার জনগণের কাছে পৌঁছয় না। আফগানিস্তান ও ইরান সীমান্তের খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চলেই এই বিএলএ গোষ্ঠীর সক্রিয়তা বেশি।
বালোচিস্তানে পাক-নিপীড়ণ
বালোচিস্তান (Balochistan Liberation Army) অঞ্চলটি পাকিস্তানের অর্থনীতি ও সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ডামাডোল ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এই অঞ্চলকেও গ্রাস করেছে। জোর করে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা বালোচ প্রদেশে প্রতিনিয়ত অত্যাচার চালায় পাক-সেনা, এমনই দাবি সেখানকার বাসিন্দাদের। বালোচিস্তানে রয়েছে একটি গভীর জলবন্দর এবং এখানকার বেশ কিছু প্রজেক্টে বেজিংয়ের বিনিয়োগ রয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজে সমৃদ্ধ বালুচিস্তানে সেখানকার নাগরিকরা যাতে লাভবান হন, তাঁদের যাতে বঞ্চিত না হতে হয়, সেই দাবিতেই সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত বালোচ লিবারেশন আর্মি। ২০০২ সালে পাক সেনা ও নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা চালায় এই সংগঠন। তখনই পাক সরকার প্রমাদ গোনে। প্রথমবার তাদের শক্তি টের পাওয়া যায় লাহোরে। এর পরে এক মহিলা জঙ্গি আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় করাচির বিশ্ববিদ্যালয়ে। বালোচিস্তানের দাবিতে বিদ্রোহ করা সমস্ত গোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা করছে বিএলএ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সব থেকে বড় অভিযান জাফর এক্সপ্রেস হাইজ্যাক। এই ঘটনায় নড়ে গিয়েছে ইসলামাবাদ। প্রতিদিন জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া পাকিস্তানই এখন হিংসার কবলে।
Leave a Reply