মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ভারত মহাসাগরে চিনের দাদাগিরি একেবারে মুখ বুজে মেনে নেবে না ভারত (Indian Naval Diplomacy)। ভারত মহাসাগরে চিনের ক্ষমতাবৃদ্ধির মোকাবিলা করতে তৈরি ভারতীয় নৌসেনা। এপ্রিলের গোড়ায় আফ্রিকা মহাদেশের ১০টি রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত মহাসাগরে নৌযুদ্ধের মহড়ায় অংশ নেবে ভারতীয় নৌসেনা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই ১০টি দেশের অনেকগুলিই ‘চিনের সহযোগী’ বলে চিহ্নিত।
ভারত-আফ্রিকা নৌ মহড়া
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর, এপ্রিলের মাঝামাঝি ভারতীয় নৌসেনা এবং তানজানিয়ার ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ যৌথ ভাবে ভারত মহাসাগরে ‘আইকেম’ নামের ওই নৌমহড়ার আয়োজন করবে। উদ্বোধন কর্মসূচি হবে তানজানিয়ার দার-এস-সালামে। নৌযুদ্ধের পাশাপাশি বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পাবে বাণিজ্যিক জাহাজের সুরক্ষা এবং জলদস্যুর মোকাবিলা। কমোরোস, জিবুতি, এরিট্রিয়া, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, মরিশাস, মোজাম্বিক, সেশেলস্ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ওই মহড়ায় অংশগ্রহণ করবে। ঘটনাচক্রে, সম্প্রতি জিবুতিতে নৌঘাঁটি নির্মাণের কাজ শুরু করেছে চিন।
অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক দৃঢ়করণ
ভারত-আফ্রিকা (Indian Naval Diplomacy) বাণিজ্য ২০২৩-২৪ সালে ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা সামুদ্রিক নিরাপত্তার গুরুত্বকে তুলে ধরে। ভারতের বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ এবং তার শক্তির আমদানি অধিকাংশই ভারত মহাসাগর দিয়ে চলে। অধিকাংশ আফ্রিকান দেশে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার লাইন অফ ক্রেডিট (LoCs) প্রদান করেছে ভারত, যার মাধ্যমে নৌ বন্দরের আধুনিকীকরণ, উপকূলীয় নজরদারি রাডার নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং বাণিজ্য সুবিধা প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ভারতের নৌবাহিনীর উপ প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল তারুণ সোবটি, আইকেম-কে আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং নৌ সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
ভারত মহাসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব
ভারত মহাসাগর (Indian Naval Diplomacy) বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। এই পথে বিশ্বের ৮০ শতাংশ তেল বাণিজ্য হয়। চিন ও ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ তৈরি করেছে এই ভারত মহাসাগর। কৃটনৈতিক মহলের অনুমান, ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ গঠনে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো যখন প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তখন ভারতের উচিত সুস্পষ্ট কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। নৌ-শক্তি বৃদ্ধি, আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার ও বহুপাক্ষিক সামুদ্রিক উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভারত তার স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে পারে। একইসঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে পারে।
চিনের সামুদ্রিক সম্প্রসারণ মোকাবিলা
এ বার সরাসরি ‘বেজিংয়ের প্রভাব বলয়ে’ হানা দিয়েছে নয়াদিল্লি। গত কয়েক বছর ধরেই আফ্রিকার দেশগুলিতে প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে চিন। অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতার পাশাপাশি সামরিক ক্ষেত্রেও চিনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আফ্রিকার অনেকগুলি দেশের। ভারতের আফ্রিকার সঙ্গে সামুদ্রিক সহযোগিতা তীব্রতর হচ্ছে চিনের আগ্রাসী এবং আধিপত্যবাদী নৌ ও অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে। চিনের মারাত্মক সামুদ্রিক অবকাঠামো বিনিয়োগ, বিশেষত জিবুতি এবং কেনিয়ায়, ঋণের স্থিতিশীলতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। চিনের প্রথম বিদেশি সামরিক ঘাঁটি, পিপলস লিবারেশন আর্মি নেভি (PLAN)-এর ঘাঁটি, জিবুতি, বৈশ্বিক অপারেশনাল উপস্থিতি বাড়িয়েছে, যা আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ভারত তো বটেই, আমেরিকাও ভারত মহাসাগরে প্রভাব বৃদ্ধির এই খেলায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল চিনের চেয়ে। এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশের ১০টি দেশকে নিয়ে ভারতের নৌমহড়া চিনের অস্বস্তি বাড়াবে বলেই অনেকে মনে করছেন।
আফ্রিকার দৃষ্টিভঙ্গি
আফ্রিকার দেশগুলো সাধারণভাবে ভারতের সামুদ্রিক উদ্যোগে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। চিনের থেকে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ নীতিই তাদেরকে আপাতত বেশি আকৃষ্ট করেছে। যেখানে গঠনমূলক ও মজবুত অংশীদারিত্ব, স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং সক্ষমতা তৈরির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতের এই সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি চিনের সমালোচিত মডেল থেকে পৃথক। চিনা মডেলে রয়েছে উচ্চ ঋণের বোঝা, পরিবেশগত প্রভাব এবং স্থানীয় সুবিধার অভাব। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন এবং মনোহর পরিক্কর ইনস্টিটিউট অফ ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিস (MP-IDSA) এর মতো শীর্ষ চিন্তনক্ষত্রগুলো ভারতের অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সহযোগিতামূলক কৌশলকে প্রশংসা করেছে, যা আফ্রিকার জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক এবং ভারতের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং পারস্পরিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
ভারত এবং চিনের (Indian Naval Diplomacy) ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। ভারতের সহযোগিতামূলক সামুদ্রিক কূটনীতি আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে এক মহৎ বিকল্প হিসেবে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ভূ-রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশা করছেন, ভারতের সামুদ্রিক কূটনীতি আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে, অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করবে এবং আফ্রিকান দেশগুলিকে চিনের বিস্তৃত প্রভাবের বিকল্প একটি কৌশলগত পথ সরবরাহ করবে। ভারতীয় কৌশল, যা প্রকৃত অংশীদারিত্ব এবং পারস্পরিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেয়, তা আফ্রিকায় দীর্ঘমেয়াদী ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সহায়ক হবে।