মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ভারত সফরে এসেছেন মঙ্গোলিয়ার প্রেসিডেন্ট খুরেলসুক উখনা। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রপতি খুরেলসুখ উখনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। এই বৈঠকে ভারত ও মঙ্গোলিয়ার মধ্যে ইউরেনিয়াম সরবরাহ, ১.৭ বিলিয়ন ডলারের মেগা অয়েল রিফাইনারি এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ছয় বছর পর এই প্রথমবার ভারত সফরে এসেছেন মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রপতি। দুই নেতার মধ্যে বৈঠকে ডিজিটাল সমাধান, খনিজ অনুসন্ধান, ও দ্রুত প্রভাব ফেলতে সক্ষম প্রকল্প সহ ১০টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
ভারত-মঙ্গোলিয়া চুক্তি
মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, “মঙ্গোলিয়া আমাদের নিকট প্রতিবেশী, যদিও দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সীমান্ত নেই। ভারতের পক্ষ থেকে মঙ্গোলিয়ার উন্নয়নে সবসময়ই দৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে থাকব।” তিনি আরও জানান, দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বিগত দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ভারতের তরফে মঙ্গোলিয়া থেকে ইউরেনিয়াম, কপার, সোনা ও দস্তা আমদানিতে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, মঙ্গোলিয়ার ইউরেনিয়াম মজুত ৯০,০০০ টনের মতো, এবং দেশটি ইতিমধ্যে ফ্রান্সের সঙ্গে বছরে ২,৫০০ টন ইউরেনিয়াম উত্তোলনের চুক্তি করেছে।
বৃহত্তম বৈদেশিক উন্নয়ন প্রকল্প
ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের সচিব (পূর্ব) পি কুমারন জানান, “আমরা মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে ইউরেনিয়াম নিয়ে অংশীদারিত্বে আগ্রহী। আগামী মাসগুলিতে আলোচনা এগোবে।” দুই নেতাই মঙ্গোল রিফাইনারি প্রকল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। ভারতের ১.৭ বিলিয়ন ডলারের লাইন অব ক্রেডিটে তৈরি এই রিফাইনারি ২০২৮ সালে চালু হবে এবং বছরে ১৫ লক্ষ টন বা দিনে ৩০,০০০ ব্যারেল তেল পরিশোধন করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, “এটি ভারতের বৃহত্তম বৈদেশিক উন্নয়ন প্রকল্প, যেখানে ২,৫০০-রও বেশি ভারতীয় বিশেষজ্ঞ মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে কাজ করছেন।”
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে জোর
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করতে ভারতের পক্ষ থেকে উলানবাটারে একজন প্রতিরক্ষা অধিকর্তা নিযুক্ত করা হবে। এছাড়াও দুই দেশের মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া, সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর প্রশিক্ষণ, এবং সাইবার সুরক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন সহ নানা উদ্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, দুই দেশ নোমাডিক এলিফ্যান্ট (Nomadic Elephant) ও খান কোয়েস্ট (Khaan Quest) নামক যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে থাকে। ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণেও আগ্রহ দেখিয়েছে মঙ্গোলিয়া। এই সফরে আরও ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে—অভিবাসন, ডিজিটাল প্রযুক্তি, মানবিক সহায়তা, খনিজ সম্পদ, সংস্কৃতি, দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন।
ভারত-মঙ্গোলিয়া পর্যটনে জোর
ভারতের লাদাখ অঞ্চল এবং মঙ্গোলিয়ার আরখানগাই প্রদেশের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করতে ভারত ২০২৬ সালে গৌতম বুদ্ধের দুই শিষ্যের পবিত্র অবশিষ্টাংশ মঙ্গোলিয়ায় পাঠাবে এবং মঙ্গোলিয়ান নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে ই-ভিসা সুবিধা চালু করবে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি খুরেলসুখ ঘোষণা করেছেন, একটি মঙ্গোলিয়ান বিমান সংস্থা শিগগিরই দিল্লি ও অমৃতসরে চার্টার্ড ফ্লাইট চালু করবে, যাতে পর্যটন বৃদ্ধি পায়। এদিন রাজধানী দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মঙ্গোলিয়ার প্রেসিডেন্ট খুরেলসুখ উখনা-র মধ্যে প্রতিনিধি স্তরের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারক আদান-প্রদান হয়। যে ক্ষেত্রগুলিতে সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে— মানবিক সহায়তা, মঙ্গোলিয়ার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য পুনরুদ্ধার, অভিবাসন, ভূতত্ত্ব ও খনিজ সম্পদ, সমবায় খাতের উন্নয়ন এবং ডিজিটাল সমাধান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এদিন দুই নেতা ভারত-মঙ্গোলিয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিটও প্রকাশ করেন। যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদী জানান, প্রতিবছর মঙ্গোলিয়ার তরুণ সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের ভারত সফরের ব্যয়ভার ভারত সরকার বহন করবে।
আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন
মোদি বলেন, “ভারত ও মঙ্গোলিয়ার সম্পর্ক কেবল কূটনৈতিক নয়, এটি আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন।” তিনি উল্লেখ করেন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় মঙ্গোলিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেই সূত্র ধরে নালন্দা ও গন্দান মঠ-কে সংযুক্ত করে এই ঐতিহাসিক সম্পর্ককে নতুন শক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মঙ্গোলিয়ার উন্নয়নে ভারত সবসময় বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার ছিল। ভারতের ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণসীমায় নির্মীয়মাণ তেল শোধনাগার প্রকল্প মঙ্গোলিয়ার জ্বালানি নিরাপত্তায় নতুন গতি আনবে বলেও জানান তিনি। এর আগে সকালে, মঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রপতি রাজঘাটে গিয়ে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানান। সন্ধ্যায় তিনি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর সম্মানে একটি রাষ্ট্রীয় ভোজর আয়োজন করা হয়। প্রেসিডেন্ট খুরেলসুখ উখনার সঙ্গে রয়েছেন উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল, যার মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রীসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, শীর্ষ সরকারি আধিকারিক, ব্যবসায়িক প্রতিনিধি এবং সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা।