শ্রীযুক্ত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও অন্যান্য ভক্তের প্রতি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ক্লেশোঽধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্ ৷
অব্যক্তা হি গর্তিদুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে ॥
(গীতা — ১২।৫)
ভক্তিযোগ যুগধর্ম—জ্ঞানযোগ বড় কঠিন—দাস আমি—ভক্তের আমি—বালকের আমি
বিজয় (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—মহাশয়! আপনি ‘বজ্জাৎ আমি’ ত্যাগ করতে বলছেন (Kathamrita)। ‘দাস আমি’-তে দোষ নাই?
শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—হাঁ, দাস আমি অর্থাৎ আমি ঈশ্বরের দাস, আমি তাঁর ভক্ত—এই অভিমান। এতে দোষ নাই বরং এতে ঈশ্বরলাভ হয়।
বিজয়—আচ্ছা, যার “দাস আমি” তার কাম-ক্রোধাদি কিরূপ?
শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—ঠিক ভাব যদি হয়, তাহলে কাম-ক্রোধের কেবল আকার মাত্র থাকে। যদি ঈশ্বরলাভের পর “দাস আমি” বা “ভক্তের আমি” থাকে, সে ব্যক্তি কারু অনিষ্ট করতে পারে না। পরশমণি ছোঁয়ার পর তরবার সোনা হয়ে যায়, তরবারের আকার থাকে, কিন্তু কারু হিংসা করে না।
নারিকেল গাছের বেল্লো শুকিয়ে ঝরে পড়ে গেলে কেবল দাগমাত্র থাকে। সেই দাগে এইটি টের পাওয়া যায় যে, এককালে ওইখানে নারিকেলের বেল্লো ছিল। সেইরকম যার ঈশ্বরলাভ হয়েছে, তার অহংকারের দাগমাত্র থাকে, কাম-ক্রোধের আকারমাত্র থাকে; বালকের অবস্থা হয়। বালকের যেমন সত্ত্ব, রজঃ, তমো গুণের মধ্যে কোন গুণের আঁট নাই। বালকের কোন জিনিসের উপর টান করতেও যতক্ষণ—তাকে ছাড়তেও ততক্ষণ। একখানা পাঁচ টাকার কাপড় তুমি আধ পয়সার পুতুল দিয়ে ভুলিয়ে নিতে পার। কিন্তু প্রথমে খুব আঁট করে বলবে (Kathamrita) এখন—না আমি দেব না। আমার বাবা কিনে দিয়েছে। বালকের আবার সব্বাই সমান—ইনি বড়, উনি ছোট, এরূপ বোধ নাই। তাই জাতি বিচার নাই। মা বলে দিয়েছে, ও তোর দাদা হয়, সে ছুতোর হলেও একপাতে বসে ভাত খাবে। বালকের ঘৃণা নাই, শুচি-অশুচি বোধ নাই। পায়খানায় গিয়ে হাতে মাটি দেয় না।
কেউ কেউ সমাধির পরও ভক্তের আমি, দাস আমি নিয়ে থাকে। আমি দাস, তুমি প্রভু, আমি ভক্ত, তুমি ভগবান—এই অভিমান ভক্তের থাকে। ঈশ্বরলাভের পরও থাকে, সব আমি যায় না। আবার এই অভিমান অভ্যাস করতে করতে ঈশ্বরলাভ হয়। এরই নাম ভক্তিযোগ।
ভক্তির পথ ধরে গেলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়। ভগবান সর্বশক্তিমান, মনে করলে ব্রহ্মজ্ঞানও দিতে পারেন। ভক্তেরা প্রায় ব্রহ্মজ্ঞান চায় না। আমি দাস, তুমি প্রভু, আমি ছেলে, তুমি মা—এই অভিমান রাখতে চায়।
বিজয়—যাঁরা বেদান্ত বিচার করেন, তাঁরাও তো তাঁকে পান?
শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—হাঁ, বিচারপথেও তাঁকে পাওয়া যায়। একেই জ্ঞানযোগ বলে। বিচারপথ বড় কঠিন। তোমায় তো সপ্তভূমির কথা বলেছি। সপ্তভূমিতে মন পৌঁছিলে সমাধি হয়। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা—এই বোধ ঠিক হলে মনের লয় হয়, সমাধি হয়। কিন্তু কলিতে জীব অন্নগত প্রাণ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা কেমন করে বোধ হবে? সে-বোধ দেহবুদ্ধি না গেলে হয় না। আমি দেহ নই, আমি মন নই, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নই, আমি সুখ-দুঃখের অতীত, আমার রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু কই?—এ-সব বোধ কলিতে হওয়া কঠিন। যতই বিচার কর, কোন্খান থেকে দেহাত্মবুদ্ধি এসে দেখা দেয়। অশ্বত্থগাছ এই কেটে দাও, মনে করলে মূলসুদ্ধ উঠে গেল। কিন্তু তার পরদিন সকালে দেখ, গাছের একটি ফেঁকড়ি দেখা দিয়েছে! দেহাভিমান যায় না। তাই ভক্তিযোগ কলির পক্ষে ভাল, সহজ।
আরও পড়ুনঃ “একটা ঢোঁড়ায় ব্যাঙটাকে ধরেছে, ছাড়তেও পাচ্ছে না—গিলতেও পাচ্ছে না…”
আরও পড়ুনঃ “বিবেক, বৈরাগ্যরূপ হলুদ মাখলে তারা আর তোমাকে ছোঁবে না”
আরও পড়ুনঃ “ধ্যান করবার সময় তাঁতে মগ্ন হতে হয়, উপর উপর ভাসলে কি জলের নিচে রত্ন পাওয়া যায়?"
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours