ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রহ্লাদচরিত্রাভিনয় দর্শনে স্টার থিয়েটারে
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ১৪ই ডিসেম্বর
ভক্তসঙ্গে ঈশ্বরকথাপ্রসঙ্গে
ঈশ্বরদর্শনের লক্ষণ ও উপায়—তিনপ্রকার ভক্ত
“আবার মধ্যম থাকের ভক্ত আছে। সে দেখে যে, ঈশ্বর সর্বভূতে অন্তর্যামীরূপে আছেন। অধম থাকের ভক্ত বলে,—ঈশ্বর (Ramakrishna) আছেন, ওই ঈশ্বর—অর্থাৎ আকাশের ওপারে। (সকলের হাস্য)
“গোলোকের রাখাল দেখে আমার কিন্তু বোধ হল, সেই (ঈশ্বরই) সব হয়েছে। যিনি ঈশ্বরদর্শন করেছেন, তাঁর বোধ হয় ঈশ্বরই কর্তা, তিনিই সব করছেন।”
গিরিশ—মহাশয়, আমি কিন্তু ঠিক বুঝেছি, তিনিই সব করছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি বলি, “মা, আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি জড়, তুমি চেতয়িতা; যেমন করাও তেমনি করি, যেমন বলাও তেমনি বলি।” যারা অজ্ঞান তারা বলে (Kathamrita), “কতক আমি করছি, কতক তিনি করছেন।”
কর্মযোগে চিত্তশুদ্ধি হয়—সর্বদা পাপ পাপ কি—অহেতুকী ভক্তি
গিরিশ—মহাশয়, আমি আর কি করছি, আর কর্মই বা কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—না গো, কর্ম ভাল। জমি পাট করা হলে যা রুইবে, তাই জন্মাবে। তবে কর্ম নিষ্কামভাবে করতে হয়।
“পরমহংস দুই প্রকার। জ্ঞানী পরমহংস আর প্রেমী পরমহংস। যিনি জ্ঞানী তিনি আপ্তসার — ‘আমার হলেই হলঞ্চ। যিনি প্রেমী যেমন শুকদেবাদি, ঈশ্বরকে লাভ করে আবার লোকশিক্ষা দেন। কেউ আম খেয়ে মুখটি পুঁছে ফেলে, কেউ পাঁচজনকে দেয়। কেউ পাতকুয়া খুঁড়বার সময়—ঝুড়ি-কোদাল আনে, খোঁড়া হয়ে গেলে ঝুড়ি-কোদাল ওই পাতকোতেই ফেলে দেয়। কেউ ঝুড়ি-কোদাল রেখে দেয় যদি পাড়ার লোকের কারুর দরকার লাগে। শুকদেবাদি পরের জন্য ঝুড়ি-কোদাল তুলে রেখেছিলেন। (গিরিশের প্রতি) তুমি পরের জন্য রাখবে।”
গিরিশ—আপনি তবে আশীর্বদ করুন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি মার নামে বিশ্বাস করো, হয়ে যাবে!
গিরিশ—আমি যে পাপী!
শ্রীরামকৃষ্ণ—যে পাপ পাপ সর্বদা করে সে শালাই পাপী হয়ে যায়!
গিরিশ—মহাশয়, আমি যেখানে বসতাম (Kathamrita) সে মাটি অশুদ্ধ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সে কি! হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে যদি আলো আসে, সে কি একটু একটু করে আলো হয়? না, একেবারে দপ্ করে আলো হয় (Kathamrita)?
গিরিশ—আপনি আশীর্বাদ করলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার যদি আন্তরিক হয়,—আমি কি বলব! আমি খাই-দাই তাঁর নাম করি।
গিরিশ—আন্তরিক নাই, কিন্তু ওইটুকু দিয়ে যাবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি কি? নারদ, শুকদেব এঁরা হতেন তো—
গিরিশ—নারদাদি তো দেখতে পাচ্চি না। সাক্ষাৎ যা পাচ্চি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য)—আচ্ছা, বিশ্বাস!
কিয়ৎক্ষণ সকলে চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা হইতেছে।
গিরিশ—একটি সাধ, অহেতুকী ভক্তি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (Ramakrishna)—অহেতুকী ভক্তি ঈশ্বরকোটীর হয়। জীবকোটীর হয় না।
সকলে চুপ করিয়াছেন, ঠাকুর আনমনে গান ধরিলেন, দৃষ্টি ঊর্ধ্বদিকে (Kathamrita)—
শ্যামাধন কি সবাই পায় (কালীধন কি সবাই পায়)
অবোধ মন বোঝে না একি দায়।
শিবেরই অসাধ্য সাধন মনমজানো রাঙা পায় ॥
ইন্দ্রাদি সম্পদ সুখ তুচ্ছ হয় যে ভাবে মায়।
সদানন্দ সুখে ভাসে, শ্যামা যদি ফিরে চায় ॥
যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র ইন্দ্র যে চরণ ধ্যানে না পায়।
নির্গুণে কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায় ॥
গিরিশ—নির্গুণে কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায়!
Leave a Reply