Shibnibas: রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত শিবনিবাসের শিব লিঙ্গ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম, এর ইতিহাস জানেন?

Nadia: শিবনিবাসকে কেন 'বাংলার কাশী' বলা হয়?
Shibnibas
Shibnibas

হরিহর ঘোষাল

এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় কষ্টি পাথরের শিব লিঙ্গ দেখেছেন? নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের শিবনিবাস (Shibnibas) গ্রামে রয়েছে এই শিবের মন্দির। সেখানে মোট তিনটি মন্দির রয়েছে। রাজরাজেশ্বর, রাগনীশ্বর এবং রাম-সীতার মন্দির। নবাবি আমলে গড়ে ওঠা এই শিব মন্দিরে এখনও বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে পুজো দিতে লক্ষাধিক ভক্ত সমাগম হয়। কলকাতা থেকে এই মন্দিরে সহজে যাওয়া যায়। শিয়ালদা থেকে গেদে লোকালে মাজদিয়া পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে টুকটুকি করে শিবনিবাস যাওয়া যায়। আর শিয়ালদা থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে কৃষ্ণনগরে (Nadia) পৌঁছে, সেখানে থেকে টুকটুকিতে বাসস্ট্যান্ড আসতে হবে। তারপর বাসস্ট্যান্ড থেকে মাজদিয়ার বাসে করে শিবনিবাস মোড়ে নেমে কিছুটা গেলেই এই মন্দিরের দর্শন মিলবে।

শিবনিবাসের নামকরণের ইতিহাস (Shibnibas)

শিবনিবাস (Shibnibas) গ্রামের নামকরণ এবং মন্দির তৈরি নিয়ে নানা মত রয়েছে। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা কার্তিকেয় চন্দ্র রায় লিখেছেন, "বর্গির আক্রমণ থেকে অত্মরক্ষার জন্যে কৃষ্ণচন্দ্র এ জায়গাটা কৃষ্ণনগর অপেক্ষা নিরাপদ মনে করে এখানে রাজপ্রাসাদ ও শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এই জায়গার নতুন নাম রাখেন 'শিবনিবাস"। অন্যমতে, নসরত খাঁ নামে এক কুখ্যাত ডাকাত এই এলাকায় বাস করতেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে দমন করার জন্যে এখানে শিবির স্থাপন করেছিলেন। একদিন সকালে নদীতে স্নান করার সময় একটি রুই মাছ কৃষ্ণচন্দ্রের সামনে এলে তাঁর এক জ্ঞাতি আনুলিয়ানিবাসী কৃপারাম রায় বলেন, এই জায়গাটি মহারাজার বাসযোগ্য। কারণ, রাজভোগ্য দ্রব্য আপনা থেকেই হাজির হয়েছে। মহারাজা বর্গির আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে এই স্থান নিরাপদ মনে করলেন এবং দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্রের পরামর্শক্রমে এখানে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করে নাম রাখলেন 'শিবনিবাস'। কেউ কেউ বলেন, এ জায়গা আগে অরণ্যময় ও জলবেষ্টিত ছিল। নসরত খাঁ নামে এক ফকির এখানে বাস করতেন। লোকে এই জায়গাকে 'নসরত খাঁর বেড়' বলত। কৃষ্ণচন্দ্র ফকির সাহেবের অনুমতি নিয়ে এখানে রাজধানী স্থাপন করেন। নদিয়া রাজ্যের মধ্যে বর্গির উপদ্রব হয়েছিল ১৭৪২ সালের মে-জুন মাসে। নিশ্চয়ই এর আগে তিনি এখানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। তিনি আত্মীয়-স্বজন ও ধনরত্ন নিয়ে উক্ত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে চলে আসেন। তখনও কিন্তু এই মন্দিরগুলি তৈরি সম্পূর্ণ হয়নি। দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্রের পরামর্শক্রমে তিনি এখানে রাজধানী ও মন্দির তৈরি করেছিলেন। ১৭৫৪ সালে মন্দির তৈরি করে থাকতে পারেন। দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্রের পরামর্শক্রমে, চূর্ণী নদীর দ্বারা 'কঙ্কনের আকারে পরিবেষ্টিত' (মতান্তরে ওই ভাবে পরিখা খনন ক'রে) এই স্থানে তিনি রাজপ্রাসাদ ও শিবমন্দির তৈরি করেন। শিবের আলয় হিসেবে এই নতুন বসতির নাম হয় শিবনিবাস। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাজধানী মাজদিয়াকে সুরক্ষা বলয়ে নিয়ে আসার জন্য খাল কেটে ইচ্ছামতী ও চূর্ণী নদীকে একত্রে জুড়ে দিয়ে একটি জনপদ গঠন করেছিলেন। যেই খালটি আজও কঙ্কণা নদী নামে পরিচিত।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে শিবের মাথায় জল ঢালতে হয়

মন্দিরের (Shibnibas) চূড়া সমেত মন্দিরের উচ্চতা ১২০ ফুট। আটকোনা মন্দির, প্রতিটি কোনায় মিনার ধরনের সরু থাম আছে। মন্দিরের ভিতর কালো শিবলিঙ্গ, উচ্চতা ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি, বেড় ৩৬ ফুট। সিঁড়ি দিয়ে উঠে শিবের মাথায় জল ঢালতে হয় এখানে। পূর্ব ভারতে এতো বড় শিবলিঙ্গ আর নেই। মন্দিরের ছাদ ঢালু ও গম্বুজ। মন্দিরে পোড়ামাটির কাজ ও গথিক স্থাপ্যশৈলীর কাজ দেখার মতো। ১৮২৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ জুন, কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড হেবার জলপথে ঢাকা যাবার সময় শিবনিবাসের মন্দির ও রাজপ্রাসাদাদি দেখে মুগ্ধ হন। ১৮২৮ খ্রীষ্ঠাব্দে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি শিবনিবাসের হিন্দু মন্দিরগুলিকে সুরম্য ও অতি উত্তম স্থাপত্যের নিদর্শন বলে বর্ণনা করেছেন। এগুলির নির্মাণে 'গথিক' খিলানের ব্যবহার তাঁকে বিস্মিত করে। শিবনিবাসে সারা বছরই ভক্ত সমাগম ঘটলেও শ্রাবণ মাসে শিব-ভক্তদের এখানে ভিড় হয় বেশি। শ্রাবনের প্রতি সোমবার নবদ্বীপের গঙ্গা থেকে জল নিয়ে ভক্তরা পায়ে হেঁটে শিবনিবাসে এসে শিবের মাথায় জল ঢালেন। সারারাত ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোর থেকে জল ঢালেন ভক্তরা। জল ঢালা চলে সারাদিন ধরে। সারা শ্রাবণ মাস ধরে মেলা চলে।  

শিবনিবাসকে কেন 'বাংলার কাশী' বলা হয়?

জনশ্রুতি আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কাশীর শিবের স্বপ্নাদেশ পান যে, তিনি কাশী ছেড়ে কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে পূজা পেতে চান। সেই আদেশ পালনার্থেই কৃষ্ণচন্দ্র শিবমন্দির (Shibnibas) স্থাপন করেন। যদিও ১০৮টি শিব মন্দির তৈরির কথা বলা হলেও সেটা সঠিক নয়। কারণ, তার কোনও কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে, শ্রী শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার সঙ্কলিত "জীবনীকোষ" (ভারতীয় ঐতিহাসিক) পুস্তকের দ্বিতীয় খন্ডে উল্লেখ আছে, শিবনিবাস প্রতিষ্ঠার পর কাশী ও কাঞ্চী থেকে আগত ব্রাহ্মণগণের উপস্থিতিতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অগ্নিহোত্র বাজপেয় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। মহারাজ "অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী" উপাধি পান। তাই শিবনিবাস কাশী তুল্য। ভারতচন্দ্র রায়ের 'অন্নদামঙ্গলে' আছে:"......কৃষ্ণচন্দ্র মতিমান। কাশীতে করিবে জ্ঞানবাপীর সমান। বিগ্রহ ব্রহ্মণ্যদেব মূর্তি প্রকাশিয়া। নিবাস করিবে শিবনিবাস করিয়া।" অতএব, শিবনিবাস মাহাত্ম্যে কাশীতুল্য। প্রচলিত ছড়ায় আছে: "শিবানিবাসী তুল্য কাশীধন্যনদী কঙ্কনা। ওপরে বাজে দেবঘড়ি নীচে বাজে ঠণ্ঠনা।"

মন্দির চত্বরে মেলা

বিড়লা জনকল্যাণ ট্রাস্ট ষাট হাজার টাকা ব্যয়ে ১৯৬৫-৬৬ সালে এই মন্দির তিনটির সংস্কার করেছিলেন। কিন্তু, মন্দিরগুলির অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মন্দিরগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ও নিত্যপুজোর জন্যে বাৎসরিক যাট হাজার টাকা দেবোত্তর ছিল। কিন্তু, সে সম্পত্তি বেহাত হয়ে গিয়েছে। বারো মাসে তেরো পার্বন নিয়েই বাঙালির জীবন। চূর্ণি নদী তীরে কৃষ্ণচন্দ্র রাজরাজেশ্বর ও রামসীতার মন্দির প্রাঙ্গণে একটি মেলার প্রচলন করেছিলেন। এ মেলা খুবই প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী। শিবচতুর্দশী উপলক্ষ্যে মেলা হত বলে এই মেলা শিবচতুর্দশীর মেলা বলে পরিচিত। জনশ্রুতি, মহাদেব নাকি একবার কৃষ্ণচন্দ্রকে স্বপ্নাদেশ দেন, তিনি কাশী ছেড়ে শিবনিবাসে (Shibnibas) এসেছেন। কৃষ্ণচন্দ্র যেন তাঁকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে কৃষ্ণচন্দ্র কোনও এক মাঘ মাসের ভীম একাদশীতে এখানে শিব প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে এই মেলা আজও চলে আসছে।

 

দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের  Whatsapp, FacebookTwitter, Telegram এবং Google News পেজ।

Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles