মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ১৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ গর্ভনমেন্ট এফিসিয়েন্সির আনুষ্ঠানিক এক্স হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট করা হয়। ওই পোস্টে একটি তালিকা দেওয়া হয়। যেখানে বিভিন্ন সংস্থার নাম ছিল। ওই সংস্থাগুলির অর্থনৈতিক বরাদ্দ বাতিল করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। তালিকায় একটি বিশেষ সংস্থার নাম রয়েছে। তা হল— কনসর্টিয়াম ফর ইলেকশনস অ্যান্ড পলিটিক্যাল প্রসেস স্ট্রেংথেনিং (Consortium for Elections and Political Process Strengthening বা সংক্ষেপে সিইপিপিএস (CEPPS)। জানা গিয়েছে, এই সংস্থাকে বাইডেন প্রশাসন বরাদ্দ করেছিল ৪৮৬ মিলিয়ন ডলার। এই বিপুল তহবিলের মধ্যে ভারতের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে ওই সংস্থা ব্যয় করেছিল ২১ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৮২ কোটি টাকা। এখানেই উঠছে প্রশ্ন! ভারতের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে এই বিপুল অর্থ বরাদ্দ ওই মার্কিন সংস্থা কার নির্দেশে করেছিল, এই নিয়েই আজকে আমাদের প্রতিবেদন। প্রথমেই আমরা জেনে নেব সিইপিপিএস আসলে কী!
১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংস্থা (CEPPS)
জানা যায়, এই সংস্থা (CEPPS) তৈরি হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। নিজেদের উদ্দেশ্য হিসেবে এই সংগঠন দেখায় যে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করা, গণতন্ত্রের প্রচার করা, সুশাসন ব্যবস্থার প্রচার করাই তাদের কাজ। যখন এই সংস্থা তৈরি করা হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল এটি একটি এনজিও। এই ধরনের যত বেসরকারি সংস্থা রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেগুলির কেন্দ্রীয় সংস্থা হল সিইপিপিএস। এই সংস্থা জানিয়েছিল তাদের তিনটি শাখা রয়েছে। একটি হল ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্টোরাল সিস্টেম, দ্বিতীয়টি হল ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট এবং তৃতীয়টি হল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট।
কোন উদ্দেশে তৈরি করা হয়?
প্রসঙ্গত, এই সংস্থার তরফ থেকে একাধিকবার দাবি করা হয়েছে যে, তারা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং যারা নির্বাচন পরিচালনা করে সেই ধরনের সংস্থার সঙ্গে কাজ করে। এর পাশাপাশি, যে কোনও দেশের সংসদে, নাগরিক সমাজের সঙ্গে গণতন্ত্র ওপর কাজ করে এই সংস্থা। তারা আরও জানায়, বিভিন্ন সমাজ কর্মীদের সঙ্গে তারা বৈঠক করে। তাদেরকে সাহায্য করে। তাদের জন্য কর্মসূচির স্থির করে এবং গণতন্ত্রকে আরও উন্নত করতে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেগুলি তারা করে। এই সংস্থা আরও দাবি করেছে যে, তাদের বর্তমানে শাখা রয়েছে পৃথিবীব্যাপী ১৪০টিরও বেশি দেশে। এই দেশগুলিতে তারা সক্রিয়। এই দেশগুলিতে তারা কাজ করে চলেছে নিরন্তর ভাবে। সংস্থার (CEPPS) আরও দাবি করেছে যে, প্রত্যেকটি দেশে তারা গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, সুশাসন- এই সমস্ত বিষয়ে কর্মসূচি নেয়। এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে যে সিইপিপিএস নামের এই সংগঠনকে ফান্ডিং করে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপে অভিযুক্ত ইউএসএআইডি বা ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট— ক্ষমতায় এসেই যাদের ফান্ডিং আটকে দিয়েছেন ট্রাম্প।
২৩ জানুয়ারি ২০২৫ থেকে বন্ধ ওয়েবসাইট
এই সিইপিপিএস সংস্থা ইউএসএআইডির পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছ থেকেও তাদের তহবিল সংগ্রহ করে। বছরের পর বছর ধরে তারা এমন কাজ করে যাচ্ছে। সিইপিপিএস দাবি করে যে, তারা যে কোনও দেশের নির্বাচনকে পর্যবেক্ষণ করে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কাজ করে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরেশিয়া, আমেরিকা এই সমস্ত জায়গাতেই তারা কাজ করে বলে জানিয়েছে। একটি পরিসংখ্যান বলছে যে, প্রতিষ্ঠা হওয়া ইস্তক ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অনুদান পেয়েছে সিইপিপিএস। ঘটনা হল সিইপিপিএস-এর আর কোনও আনুষ্ঠানিক ওয়েবসাইট বর্তমানে কার্যকর নেই। এই সংস্থা ইউএসএআইডি থেকে লক্ষ লক্ষ ডলারের তহবিল নিয়েছে এবং ১৯৯৫ সাল থেকেই তারা সক্রিয় কিন্তু ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ সালের পর থেকে তারা তাদের ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে।
সংস্থাকে নিয়ে একাধিক বিতর্ক
২০২৩ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ইউএসএআইডি যে নথি প্রকাশ করছে সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য তারা দুই বিলিয়ন ডলার তহবিল দিয়েছে। আরও আশ্চর্যজনক তথ্য সামনে আসছে যে, ২০২১ সালে ইউএসএআইডি তাদের মোট তহবিলের ৬৬ শতাংশই প্রদান করছে সিইপিপিএস -কে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য সিইপিপিএস যে দাবি করে, তা কিন্তু আসল সত্য নয়। সিইপিপিএস কোনও সরকারি সংস্থা নয়। কিন্তু একে অর্থনৈতিকভাবে তহবিল প্রদান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের অংশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। প্রসঙ্গত, কোনও দেশের নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে না সিইপিপিএস। এটি সরাসরি সেদেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজকে ফান্ডিং করে। এখানেই উঠছে প্রশ্ন। এখানেই ছড়িয়েছে বিতর্ক। অর্থাৎ কোনও দেশের সার্বভৌমত্বকে হরণ করা, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বদল করার কাজও করে তারা।
২০১৯ সালের প্রতিবেদন
২০১৯ সালে ইউএসএআইডির একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিকে সহায়তা করার জন্য তারা সিইপিপিএস-এর মত একটি সংস্থার উপরে নির্ভর করে। সিইপিপিএস-এর উপর এই নির্ভরশীলতা ইউএসএআইডিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে এবং এর বিশ্বাসযোগ্যতা কমতে শুরু করে। এর পাশাপাশি বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগও উঠতে থাকে।
দেশ বিরোধী শক্তির ফান্ডিং
প্রসঙ্গত, ভারতবর্ষে এই সংস্থা কাজ চালিয়েছে তাদেরই শাখা সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্টোরাল সিস্টেমসকে নিয়ে। ২০১২ সালে ইউপিএ সরকার থাকাকালীন তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার এসওয়াই কুরেশির সঙ্গে এই ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্টোরাল সিস্টেমস এক চুক্তি করে। প্রেস বিবৃতি জারি করে তৎকালীন ভারতের নির্বাচন কমিশন। যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে বা হয়, ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্ট্রোরাল সিস্টেমস (আইএফইএস)-এর সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি নেবে দেশের নির্বাচন কমিশন। যৌথ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করা হবে। একইসঙ্গে গবেষণা চলবে কিভাবে গণতন্ত্রকে আরও উন্নত করা যায়। আসল উদ্বেগের বিষয় হল আইএফইএস ইতিমধ্যে সেই সমস্ত সংস্থার কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছে যেগুলি ভারত বিরোধী সংগঠন বলেই পরিচিত। এরমধ্যে রয়েছে ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন। এই ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন এর মালিক জর্জ সরোস ভারত বিরোধী কার্যকলাপে অভিযুক্ত। এখানেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। তবে এইভাবে দেশবিরোধী শক্তির ফান্ডিং নিয়ে আসলে কোন কোন রাজনৈতিক দলকে সাহায্য করেছিল ওই মার্কিন সংস্থা।
ইউএসএআইডি-র ওপরে রাশ (USAID)
ক্ষমতায় আসার পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) বিতর্কিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (USAID) এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। এই সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মীদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদারদের বরখাস্ত করা হয়েছে এবং বিদেশ থেকে যে সাহায্য এরা পেত, সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ইলন মাস্ক ইতিমধ্যেই এই সংস্থাকে একটি অপরাধী সংস্থা হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এ বিষয়ে এক্স মাধ্যমে তিনি পোস্টও করেছেন। প্রসঙ্গত, ইউএসএআইডি ছয়ের দশকে গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা কর্মসূচি পালন করা। যদিও এরই আড়ালে চলছিল নানা রকমের অ্যাজেন্ডা। গোপনে তহবিল সংগ্রহ, যে কোনও দেশের সার্বভৌমত্ব হরণ করা, সরকার ফেলার ষড়যন্ত্র করছিল তারা। এই সংস্থা যেসব সার্বভৌম দেশগুলির ওপর নজর রাখত, তার মধ্যে ভারতও ছিল। এদেশে মাওবাদীদের ফান্ডিং করা থেকে, খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তকরণে ফান্ডিং এসবও করত তারা।
Leave a Reply