মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ক্রমেই বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। গত বছর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। উষ্ণায়নের ফলে হিমালয় (Himalaya) অঞ্চলে শতাধিক হিমবাহ (Melting Glaciers) দ্রুত গলে যাচ্ছে। আর সেই বরফগলা জলে ক্রমশ বাড়ছে হ্রদের আয়তন। এর ফলে বড়সড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
বড় হ্রদগুলির প্রতি চারটির মধ্যে একটির আয়তন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে
প্রসঙ্গত, হিমালয় অঞ্চলে ১০ হেক্টরের চেয়েও বড় হ্রদগুলির প্রতি চারটির মধ্যে একটির আয়তন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবণতা শুরু হয়েছে ১৯৮৪ সাল থেকে। তবে সাম্প্রতিক কালে পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে। এর ফলে হিমবাহ গলা জল হ্রদের (Melting Glaciers) দুকূল ছাপিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বন্যার ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে ক্রমেই। আমরা যদি ১৯৮৪ থেকে ২০২৩ সালের তথ্য দেখি, তাহলে দেখা যাবে যে হিমালয়ে ২,৪৩১ হ্রদ রয়েছে, যেখানে ১৯৮৪ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ৬৭৬ হ্রদ রয়েছে যার আয়তন বিস্তৃত হয়েছে। এর মধ্যে ১৩০টি ভারতে রয়েছে। সিন্ধু নদীর উপর ৬৫টি হিমবাহী হ্রদ, গঙ্গার উপর ৭টি এবং ব্রহ্মপুত্রে ৫৮ টি হিমবাহী হ্রদ গঠিত হয়েছে। এই ৬৭৬ হ্রদের মধ্যে ৬০১টি আকারে দ্বিগুণেরও বেশি প্রসারিত হয়েছে।
কেদারনাথ ও সিকিমের স্মৃতি
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৬ জুন রাতে সমগ্র কেদারনাথ (Kedarnath) উপত্যকা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাহাড়ের উপরিভাগে অবস্থিত একটি হ্রদ ফেটে যাওয়ার কারণে এমন বন্যা হয়েছিল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। এই বিপর্যয়ে মারা গেছেন ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে এই দুর্ঘটনার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন এখনও বিদ্যমান। এই ধ্বংসযজ্ঞের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে হিমালয় অঞ্চলের বরফ গলেই সেই বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড (GLOF) বলা হয়। সাম্প্রতিককালে, হিমবাহ ফেটে সিকিম ও উত্তরবঙ্গে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। সেই স্মৃতি আজও টাটকা।
গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড (GLOF)
গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড (GLOF) হল এমন একটি পরিস্থিতি যখন হিমবাহ গলনের ফলে সমতল ভূমিতে অত্যধিক জলের প্রবাহ ঘটে এবং প্রাকৃতিক বাঁধ বা হ্রদে জলের স্তর বৃদ্ধির ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সহজ কথায়, একে হ্রদ ফেটে যাওয়াও (Melting Glaciers) বলা হয়। যার কারণে হ্রদ সংলগ্ন এলাকা এবং নিচু এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরকে গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাডের (GLOF) জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর জম্মু-কাশ্মীরের পরেই রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখন্ড। ফলে হিমবাহ গলা জল অন্যান্য সমস্ত দেশের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ওপরেও বিরাট আকার নেবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এমন কিছু ঘটলে আবার ফিরে আসবে কেদারনাথের স্মৃতি।
উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীরা
গোটা ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীরা। প্রখ্যাত হিমবাহবিদ অনিল ভি কুলকার্নির আশঙ্কা, এই হ্রদ যে ভাবে বেড়ে চলেছে তা ভবিষ্যতে মানালি লে হাইওয়ে পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। তার জেরে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা ওই অঞ্চলের জনবসতি। দিভেচা সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর বিজ্ঞানী অনিল জানিয়েছেন, অবিলম্বে এই বিষয়ে পদক্ষেপ করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গেও আলোচনা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গত বছর সিকিমের (Sikkim) লোনাক হ্রদের জল (Melting Glaciers) উপচে বন্যার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন ওই হিমবাহবিদ।
হিমবাহবিদের আশঙ্কা
তবে প্রখ্যাত হিমবাহবিদ মিরিয়াম জ্যাকসন গত বছরেই বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি জানান, হিমবাহ গলে আরও বহু জলাশয় তৈরি হবে। বাড়বে বহু জলাশয়ের আয়তনও। যা ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলে বন্যা তৈরির ইঙ্গিতবাহী। গবেষকদের মতে, আগামী দশকে মধ্য ও পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের অধিকাংশ হিমবাহ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিছু হিমবাহ গলে যাওয়ার আশঙ্কা আরও গুরুতর হবে। যার কারণে আসন্ন বন্যায় (Melting Glaciers) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে আগামী শতাব্দীর মধ্যে হিমালয়ের ৭৫ শতাংশ বিলীন হয়ে যেতে পারে। ফলে পরিবেশের এমন ক্ষতি হবে, যা পূরণ করা সম্ভব নয়।
পৃথিবী জুড়ে তীব্র জল সংকট
অন্যদিকে হিমবাহ গলে কয়েক দশক পর নদী শুকিয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে দেখা দিতে পারে পৃথিবী জুড়ে তীব্র জল সংকট। এর মূল কারণ হিসেবে বিশ্ব উষ্ণায়নকেই দায়ী করেছেন গবেষকরা। গত ৪ দশকে হিমালয় পর্বতমালার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ হিমবাহ বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য গলে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। এশিয়ায় (Asia) মূল নদীগুলির উৎপত্তি এই হিমালয় থেকেই। ফলে এশিয়ার প্রায় ৮০ কোটি মানুষের জীবনধারা এসব নদীর ওপর নির্ভরশীল। দ্বিগুণ গতিতে হিমবাহ গলতে থাকলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ঘনবসতিপূর্ণ এই অঞ্চলে একসময় তীব্র জল সংকটের (water crisis) কারণে ভয়ানক বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই সময় থাকতেই এবার সচেতন হন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours