Gajan Utsav: বাংলায় শুরু গাজনের উৎসব, চৈত্রশেষে মহাদেবের আরাধনায় মেতে ওঠেন ভক্তরা

Gajan Utsav in west Bengal know the importance and significance

মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: চৈত্র শেষে গাজনের ঢাক (Gajan Utsav)। গ্রাম থেকে শহর শোনা যাচ্ছে ঢাক-ঢোল-কাঁসরের আওয়াজ। বাংলা বছরের শেষ উৎসব হল গাজন। এই উৎসবে দেবাদিদেব মহাদেবের আরাধনায় মেতে ওঠেন ভক্তরা। গাজন উৎসবে জাতপাতের বেড়াজাল টপকে সকলেই সামিল হন শিব আরাধনায়। এবছরের গাজন শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার, মদন ত্রয়োদশী থেকে। চলবে সোমবার, চৈত্র সংক্রান্তি পর্যন্ত। প্রসঙ্গত, মদন ত্রয়োদশী হল হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ তিথি। যা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে পালিত হয়। এই ত্রয়োদশীতে ভগবান বিষ্ণুর পুজো করা হয়। একইসঙ্গে প্রেমদেব মদন বা কামদেবের নামও যুক্ত, তাই এটি মদন ত্রয়োদশী নামেই পরিচিত।

গাজন (Gajan) শব্দের উৎপত্তি

গবেষকরা জানাচ্ছেন, গাজন (Gajan Utsav) শব্দের উৎপত্তি ‘গর্জন’ থেকে। অনেকের ধারণা, শিব সাধনার সময় সন্ন্যাসীদের হুঙ্কার বা রব থেকেই গাজন শব্দের উৎপত্তি। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও মেলে গাজনের উল্লেখ। পুরাণের প্রকৃতিখণ্ডে লেখা রয়েছে, ‘‘চৈত্র মাস্যথ মাঘেবা যোহর্চ্চয়েৎ শঙ্করব্রতী। করোতি নর্ত্তনং ভক্ত্যা বেত্রবানি দিবাশিনম্।। মাসং বাপ্যর্দ্ধমাসং বা দশ সপ্তদিনানি বা। দিনমানং যুগং সোহপি শিবলোক মহীয়তে।।’’ এর অর্থ চৈত্রে কিংবা মাঘে এক-সাত দশ-পনেরো কিংবা তিরিশ দিন হাতে বেতের লাঠি নিয়ে শিবব্রতী হয়ে নৃত্য ইত্যাদি করলে মানুষের শিবলোক প্রাপ্ত হয়।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, শিবের সঙ্গে কালির বিবাহ সম্পন্ন হয়

অনেক গবেষকের ধারণা, গাজন (Gajan Utsav) উৎসবে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব। আবার বাংলার মঙ্গলকাব্যতেও গাজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন ধর্মমঙ্গল কাব্যে রয়েছে এর বিস্তৃত বিবরণ। তবে অন্য একটি অংশের মতে, গা শব্দ বলতে গ্রামকে বোঝায়। আর, জন শব্দ বলতে জনসাধারণকে বোঝায়। অর্থাৎ গ্রামের জনসাধারণের যা উৎসব তাই গাজন। জনশ্রুতি রয়েছে, গাজনই হল সেই দিন যেদিন শিবের সঙ্গে কালির বিবাহ সম্পন্ন হয়। আরও লৌকিক কথা হল, গাজনের সন্ন্যাসীরা হলেন আসলে শিবের বরপক্ষ।

গাজন উৎসবের তিনটি অংশ

গাজন উৎসবের তিনটি অংশ থাকে। যথা- ঘাট সন্ন্যাস, নীলব্রত এবং চড়ক। অনেক জায়গাতে গাজন উৎসব (Gajan Utsav) চৈত্র মাসের প্রথম দিন থেকেই ভক্ত সন্ন্যাসীরা পালন করতেন, সেটা অনেক আগেকার কথা অবশ্য। তবে বর্তমান সময়ে চৈত্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে অথবা তিন দিন আগে থেকেই কঠোরব্রত পালন করেন সন্ন্যাসীরা। এই সময়ে পরিচ্ছন্ন বস্ত্র ধারণ করে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন সন্ন্যাসীরা। এবছর নীলব্রত পড়েছে রবিবার, ১৩ এপ্রিল। পরের দিন, অর্থাৎ, সোমবার ১৪ এপ্রিল, চৈত্র সংক্রান্তির দিন অনুষ্ঠিত হবে চড়ক পুুজো।

অনেক জায়গাতে মুখোশ নৃত্যের প্রচলন দেখা যায়

গাজনে অনেক জায়গাতে মুখোশ নৃত্যের প্রচলন দেখা যায়। যা স্থানীয় ভাষায় বোলান গান নামেও পরিচিত। এগুলি বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, নদিয়া বীরভূম জেলাতে দেখা যায়। এই সময়ে শিব-গৌরী সাজেন অনেকেই। এর পাশাপাশি নন্দী, ভৃঙ্গি ভুত-প্রেত, দৈত্য, দানব প্রভৃতি ধরনের সং সেজেও নৃত্য করেন সবাই (Gajan Utsav)। লৌকিক ছড়া, আবৃত্তি গানও করা হয়। গাজনের ঠিক পরের দিন অনুষ্ঠিত হয় নীল পুজো। গ্রাম্য মহিলারা সন্তানদের মঙ্গল কামনায় এ দিন ফল, আতপ চাল, অর্থ দান করে থাকেন।

প্রথম গাজন পুজোর প্রচলন কবে

পৌরাণিকভাবে গাজন উৎসবের (Gajan Utsav) সূচনা নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। কথিত আছে, বান নামে এক রাজা ছিলেন প্রবল শিব ভক্ত। তিনি দেবাদিদেব মহাদেবকে তুষ্ট করতে কঠোর তপস্যা করেন। শিব ভক্তির সেই সূত্র মেনে এখনও পর্যন্ত সন্ন্যাসীরা চড়কের বান পরেন। কাঁটার উপরে ঝাঁপও দেন। গাজন যেন এক প্রকার কৃচ্ছসাধনের ব্রত পালন করেন সন্ন্যাসীরা। আগুন ঝাঁপ, কাঁটা ঝাঁপ কপাল ফোঁড়া ইত্যাদি দেখা যায়। গবেষকরা বলছেন, ১৪৮৫ সালের রাজা সুন্দর আনন্দ ঠাকুর প্রথম চড়ক পুজোর প্রচলন করেন। সেই থেকেই এই প্রথা মেনে আসছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।

অন্ত্যজ শ্রেণির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই সন্ন্যাস ধর্ম পালন করেন

গাজনের এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভূত-প্রেত, পুনর্জন্ম প্রভৃতি বিষয়। এক সময়ে গাজনের (Gajan Utsav) সন্ন্যাসীরা হুড়কো দিয়ে নিজেদেরকে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুত বেগে ঘুরতেন। সেসময় ব্রিটিশ সরকার আইন প্রণয়ন করে এই নিয়ম-নীতি বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে বর্তমান সময়ে আজও অনেক স্থানে এই রীতি দেখা যায়। গাজনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এই সময়ে অন্ত্যজ শ্রেণির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই সন্ন্যাস ধর্ম পালন করতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় শিব-পার্বতী সেজে কেউ কেউ ভিক্ষা পাত্র নিয়ে বের হন। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে আতপ চাল, কাঁচা আম, কাঁচা কলা প্রভৃতি সংগ্রহ করেন।

গ্রামবাংলায় লোকপ্রিয় গাজন

পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ সর্বত্রই গাজন উৎসব দেখা যায়। মালদা জেলায় গম্ভিরা উৎসব (Gajan Utsav) পালিত হয় এই সময়। কোথাও তা চৈত্র সংক্রান্তি থেকে হয়, কোথাও তা আবার পয়লা বৈশাখে হয়। চার দিন ধরে চলে এই উৎসব। একদিকে যেমন শিব আরাধনা চলে, তেমনই অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনে নানা সমস্যার কথা ভক্তরা দেবাদিদেব মহাদেবের উদ্দেশে বলতে থাকেন। সেখানে সমস্ত ধরনের কথাই খোলামেলা বলা হয়। রাজনীতি থেকে জীবনের বঞ্চনা কোনও কিছুই বাদ যায় না। পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির পাশাপাশি কলকাতাতেও দেখা যায় চৈত্র সংক্রান্তির সং সাজা। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে সঙ বের হয়। কলকাতার জেলে পাড়ার সঙ্গে কথাও কম বেশি সকলেই জানেন। এর পাশাপাশি কালীঘাটের নকুলেশ্বর তলা সহ বেশ কিছু জায়গায় আজও গাজন পালিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত গাজনের মেলা

চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। গাজন সাধারণত তিনদিন ধরে চলে। এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল মেলা। চৈত্রসংক্রান্তির গাজনে কালী নাচ একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। ধর্মের গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা গলিত শব নিয়ে নৃত্য বা মড়াখেলা (কালিকা পাতারি নাচ)। জ্যৈষ্ঠমাসে মনসার গাজনে মহিলা সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যারা অংশ নেয়, তারা চড়কের সন্ন্যাসীদের মতোই অনুষ্ঠান পালন করে। বর্ধমান জেলার পাঁড়ুই গ্রামের শিবের গাজন যা পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় গাজন এর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রতি বছর আঠাশ ফলের দিন অর্থাৎ আঠাশে চৈত্র, শ্মশান চিরন নামে বিশাল আচার অনুষ্ঠান হয়। যা প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো।

বাংলার কয়েকটি জনপ্রিয় গাজন উৎসব

পূর্ব বর্ধমান: শ্রীখণ্ড গ্রামের গাজন বাবা দুগ্ধ কুমার শিবের গাজন হিসেবে বিখ্যাত।
মালদা: মালদায় গাজনের নাম গম্ভীরা।
জলপাইগুড়ি: জলপাইগুড়িতে গাজনের নাম গমীরা।
বাঁকুড়া: বাঁকুড়া জেলার ছাতনা থানার ঝাঁটিপাহাড়ী গ্রামের গাজনও খুব বিখ্যাত। তবে তা চৈত্র মাসে নয়, বরং জ্যৈষ্ঠ মাসের ২৫/২৬ তারিখ নাগাদ পালিত হয়। এই অনুষ্ঠান হুজুগে গাজন উৎসব নামে পরিচিত।

Please follow and like us:

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

LinkedIn
Share