মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: সংখ্যার জগৎ শুধু গণিতের অঙ্কেই সীমাবদ্ধ নয়। দর্শন, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা এবং সভ্যতার গভীরেও রয়েছে এর তাৎপর্য। ভারতীয় (Bharat) সভ্যতা, পৃথিবীর প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক, সেখানে প্রতিটি সংখ্যার এক একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘সাত’ (৭) সংখ্যা (Number seven) এক অনন্য স্থান অধিকার করেছে। সময়, স্থান, ধর্মীয় আচার, পুরাণকথা, সামাজিক রীতি কিংবা আধ্যাত্মিকতা—সবেতেই ‘সাত’ তার রহস্যময় গুরুত্ব নিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
সূর্য ও রথসপ্তমী: জীবনের শক্তি
প্রতি বছরের মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে পালিত হয় রথসপ্তমী বা সূর্য-সপ্তমী। সূর্যকে হিন্দু ধর্মের দেবতা মানা হয়। এই দিনে সূর্য পূজিত হন জীবনের ধারক শক্তি হিসেবে। পুরাণ মতে, সূর্যের রথ টেনে নিয়ে যায় সাতটি ঘোড়া, আর আধুনিক বিজ্ঞান বলছে সূর্যালোকে ভেঙে যায় সাতটি রঙে—লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, আকাশী ও বেগুনি। অতএব, সূর্য ও সাতের যোগসূত্র কেবল পুরাণেই নয়, বিজ্ঞানের ভিত্তিতেও প্রতিফলিত।
সপ্তলোক: মহাবিশ্বের সাত স্তর
হিন্দু (Bharat) দর্শনে মহাবিশ্বকে সাতটি জ্যোতির্ময় স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে,ভূলোক,ভুবর্লোক,স্বর্লোক,মহালোক,জনলোক,তপোলোক,সত্যলোক। এই সাতটি স্তর মানুষের চেতনাবিকাশের বিভিন্ন ধাপের প্রতীক। নিচের দিকে রয়েছে পাতাললোকসমূহও, যা জড়তা ও অন্ধকারকে নির্দেশ করে। ফলে ‘সাত’ সংখ্যা একদিকে ঊর্ধ্বগামী আধ্যাত্মিক যাত্রা আবার অন্যদিকে নিচের স্তরের অচেতন জগতেরও প্রতিচ্ছবি।
সপ্তর্ষি: জ্ঞানের সাত দিশারী
ঋষিদের মধ্যে সপ্তর্ষি—অত্রি, ভরদ্বাজ, গৌতম, জামদগ্নি, কশ্যপ, বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র—ভারতীয় (Bharat) জ্ঞানের মূল স্তম্ভ। তাঁরা শুধু দর্শন ও বেদীয় জ্ঞানের ধারকই নন, বরং মানব সমাজকে শৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার পথ দেখিয়েছেন। আকাশে ধ্রুবতারা ঘিরে যে নক্ষত্রমণ্ডলীকে আমরা ‘সপ্তর্ষিমণ্ডল’ বলি, সেটি আজও তাঁদের অমর অবদানের প্রতীক।
সপ্তচিরঞ্জীবী: অমরত্বের প্রতীক
ভারতীয় (Bharat) পুরাণে সাত চিরঞ্জীবীর কথা বলা হয়েছে। তাঁরা হলেন—অশ্বত্থামা, মহাবলী, ব্যাসদেব, হনুমান, বিভীষণ, কৃপাচার্য ও পরশুরাম। বিশ্বাস করা হয়, এঁরা যুগে যুগে বেঁচে থাকবেন এবং মানবজাতিকে পথ দেখাবেন। এটি ‘অমরত্ব’ ও ‘অবিনশ্বর শক্তির’ প্রতীক, যা সময়কে ছাপিয়ে চিরন্তন সত্যে প্রতিষ্ঠিত।
সপ্তসিন্ধু: সভ্যতার প্রাণশক্তি
ভারতীয় (Bharat) সভ্যতার গোড়াপত্তন নদীনির্ভর সমাজে। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে উল্লেখিত সপ্তসিন্ধু—গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু ও কাবেরী—ভারতীয় জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই নদীগুলো শুধু ভৌগোলিক নয়, আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও জীবনদাত্রী।
সপ্তদ্বীপ: পৃথিবীর ধারণা
প্রাচীন ভারতীয় কল্পনায় পৃথিবী বিভক্ত সাত দ্বীপে—জম্বুদ্বীপ, প্লক্ষ, শাল্মল, কুশ, ক্রোঞ্চ, শক ও পুষ্কর। এগুলো আসলে পৃথিবী ও মহাবিশ্বকে বোঝার প্রচেষ্টা, যা ভৌগোলিক কল্পনার পাশাপাশি মহাজাগতিক দৃষ্টিও উপস্থাপন করে।
সপ্তরঙ: রঙের রহস্য
বৃষ্টির পরে আকাশে যে ইন্দ্রধনু দেখা যায়, সেটি সাতটি (Number seven) রঙে গঠিত। এই সাত রঙ সৃষ্টির বৈচিত্র্য, জীবনচক্রের বহুমাত্রিকতা ও প্রকৃতির সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করে।
সপ্তদিবস: সময়ের ছন্দ
মানবসভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সপ্তাহের ধারণা। সাত দিনকে কেন্দ্র করে সময়চক্র আবর্তিত হয়—রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি। এভাবে মানুষের কাজকর্ম, আচার, এমনকি জ্যোতিষ শাস্ত্রও সাত দিনের সঙ্গে সংযুক্ত।
সপ্তপুরী: মুক্তির তীর্থ
ভারতীয় ধর্মে সাতটি মোক্ষদায়িনী নগরী—অযোধ্যা, মথুরা, মায়া (হরিদ্বার), কাশী, কাঞ্চী, উজ্জয়িনী ও দ্বারকা। এগুলোকে বলা হয় সপ্তপুরী, যা মোক্ষ বা মুক্তি অর্জনের পবিত্র ক্ষেত্র।
সপ্তপদী: বিবাহের বন্ধন
ভারতীয় বিবাহ প্রথায় দম্পতি সাত পা (সপ্তপদী) এগিয়ে যান এবং প্রতিটি পদক্ষেপে এক একটি শপথ গ্রহণ করেন। এই সাত শপথেই বিবাহের পূর্ণতা আসে। অতএব, বিবাহ শুধু সামাজিক প্রতিষ্ঠান নয়, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক চুক্তি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত।
সপ্ত মাতৃকা: দেবী শক্তির বহুরূপ
তন্ত্র ও পুরাণে সাত মাতৃকা দেবী—ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, ইন্দ্রাণী ও চামুণ্ডা—নারী শক্তির বিভিন্ন দিককে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করেন। তাঁরা সৃষ্টির শক্তি, ধ্বংস ও পুনর্গঠনের ধারক।
ভারতীয় সভ্যতায় ‘সাত’
ভারতীয় সভ্যতায় ‘সাত’ সংখ্যা কেবল গণনার অঙ্ক নয়, বরং সময়, স্থান, আচার, আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতির বহুমাত্রিক প্রতীক।
রথসপ্তমী থেকে শুরু করে সপ্তলোক, সপ্তর্ষি, সপ্তসিন্ধু, সপ্তপুরী কিংবা সপ্তপদী—সবক্ষেত্রেই ‘সাত’ জীবন, শক্তি, চিরন্তন সত্য, মুক্তি ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে আছে। অতএব, ‘সাত’ ভারতের আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত। যা যুগে যুগে সভ্যতাকে একত্রিত করেছে এবং আজও মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে।
Leave a Reply