মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: অশান্ত বাংলাদেশ। তাই ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে আন্তঃসীমান্ত করিডর বাস্তবায়নের কাজ। এজন্য প্রয়োজন শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা, রেগুলেটরি অনুমোদন এবং লজিস্টিক সমন্বয় (Economic Corridors)। মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অশান্ত বাংলাদেশের পক্ষে যা করা এই মুহূর্তে একপ্রকার অসম্ভব। তাই কঠিন হয়ে উঠছে (Northeast India) আন্তঃসীমান্ত করিডর বাস্তবায়নের কাজ।
ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা (Economic Corridors)
ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে পরিকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি করিডর, যা “চিকেনস নেক” নামে পরিচিত, এই সংকীর্ণ ভূখণ্ডটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত করার প্রধান পথ। এর ফলে এই অঞ্চলে যানজট নিত্যদিনের ঘটনা। অঞ্চলটি নানা দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিবহুল এবং সংবেদনশীল। তবে, নয়া দুটি প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডর— হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ আন্তঃসীমান্ত অর্থনৈতিক করিডর ও ভুটান-বড়োল্যান্ড-বঙ্গোপসাগর (B3) করিডর— এই অঞ্চলের সংযোগ, বাণিজ্য ও নিরাপত্তায় বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা রাখে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। এই দুটি করিডরের কাজ বাস্তবায়িত হলে উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে যাতায়াতের সময়, কমবে খরচ, বাড়বে অর্থনতৈক সুযোগ। আরও একটা লাভ হবে। সেটি হল ঐতিহ্যবাহী শিলিগুড়ি রুটের চাপ কমা।
হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ করিডর
হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ করিডর একটি উচ্চকাঙ্খী প্রকল্প। এর মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের মাধ্যমে মেঘালয় এবং বৃহত্তর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সড়ক ও রেল সংযোগকে আরও শক্তিশালী করা। পশ্চিমবঙ্গের হিলি এবং মেঘালয়ের গারো পাহাড় অঞ্চলের মহেন্দ্রগঞ্জ—উভয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত শেয়ার করে, যা এই করিডরকে একটি কৌশলগত (Economic Corridors) আন্তঃসীমান্ত রুটে পরিণত করেছে। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা বলেন, “এই ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ করিডর ভ্রমণের সময় এবং খরচ ২৫-৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।” বর্তমানে, কলকাতা থেকে মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং অসমের বরাক ভ্যালিতে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের জন্য ব্যবহার করতে হয় চিকেনস নেক। এই রুটে যাতায়াত সময় এবং খরচ সাপেক্ষ। এই করিডর চালু হলে ভ্রমণের দূরত্ব একধাক্কায় কমে যাবে ৬০০-৭০০ কিলোমিটার। এতে লাভবান হবেন ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা উভয়েই। কারণ পরিবহণ খরচ কমলে প্রত্যাশিতভাবেই কমে যাবে পণ্যের দরও (Northeast India)।
এনএইচআইডিসিএল
ন্যাশনাল হাইওয়ে অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (এনএইচআইডিসিএল) ইতিমধ্যেই সড়ক সংযোগ বিশ্লেষণের কাজ শেষ করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্যও শেয়ার করেছে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, করিডরের পরিকল্পনা এখনও বাতিল হয়নি। এছাড়াও, ভারতীয় রেলওয়ে হিলি থেকে মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘোড়াঘাট, পলাশবাড়ি এবং গাইবান্ধার মধ্যে দিয়ে একটি আন্তঃসীমান্ত রেলওয়ে প্রকল্পের জন্য ফাইনাল লোকেশন সার্ভে অনুমোদন করেছে। যদিও এর বাস্তবায়নে সময় লাগতে পারে, তবুও এই পদক্ষেপ করিডর সম্ভাবনা বাস্তবায়নের দিকে ইতিবাচক অগ্রগতির ইঙ্গিত (Economic Corridors) দেয়।
ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক
তবে, এই দুই প্রকল্পের বাস্তবায়ন নির্ভর করবে ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সরকার পরিবর্তনের আগে, এই করিডর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ার পর এই দুই করিডর রূপায়ণে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তার মেঘ। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ভারতকে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য ঢাকার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। জানা গিয়েছে, এই করিডর একটি প্রধান অর্থনৈতিক ধমনী হিসেবে কাজ করবে, যা মেঘালয়, বরাক ভ্যালি, ত্রিপুরা এবং অন্যান্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের ব্যবসায়ীদের পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে আরও দক্ষ বাণিজ্যে সক্ষম করবে। পণ্য দ্রুত চলাচলের মাধ্যমে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। সুযোগ বাড়বে নয়া কর্মসংস্থানের (Northeast India)।
ভুটান-বড়োল্যান্ড-বঙ্গোপসাগর করিডর
দ্বিতীয় প্রস্তাবিত করিডর হল—ভুটান-বড়োল্যান্ড-বঙ্গোপসাগর করিডর—এটি একটি কৌশলগত উদ্যোগ যা অসম ও মেঘালয়ের মাধ্যমে ভুটানকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে। এই করিডরের উদ্দেশ্য হল বাণিজ্য ও পরিবহণকে আরও অনায়াস করা এবং ভারত ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। বড়োল্যান্ড, অসমের জোগিঘোপা এবং মেঘালয়ের ফুলবাড়ি এই বি-থ্রি করিডরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক হাব হিসেবে কাজ করবে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত ফুলবাড়ির অবস্থান এই করিডরের সম্ভাবনাকে আরও বৃদ্ধি করেছে। কারণ এটি জলপথে পণ্য পরিবহণের সুযোগ দেয়। এর ফলে সড়ক, রেল ও জলপথের সমন্বয়ে পরিবহণ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব হবে।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার
ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা এই করিডরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ভুটান আমদানি ও রফতানির জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল। উন্নত পরিকাঠামো এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বিনিময়কে আরও বৃদ্ধি করবে। উন্নত সংযোগ ভুটানের জলবিদ্যুৎ, কৃষিপণ্য ও হস্তশিল্পের মতো রফতানিগুলিকে উপকৃত করবে। এর পাশাপাশি ভারতকে ভুটানের বাজারে আরও ভালো প্রবেশাধিকার দেবে (Economic Corridors)। এছাড়াও, ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রভাবিত বড়োল্যান্ড, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্য নেটওয়ার্কে (Northeast India) একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংযোগ হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে। এই করিডর পরিকাঠামো, লজিস্টিক এবং শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে, যা চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং এই অঞ্চলের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে।
বাংলাদেশের বন্দরগুলিতে ভারতের প্রবেশাধিকার
এই করিডর বাংলাদেশের বন্দরগুলিতে ভারতের প্রবেশাধিকারের সম্পূরক হিসেবেও কাজ করবে। দু’বছর আগে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে ভারতের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে। এই চুক্তির ফলে কলকাতা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি, বিশেষ করে ত্রিপুরার মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৮০০ কিমি কমিয়েছে। বি-থ্রি করিডরের মাধ্যমে, ভারত বাংলাদেশের জলপথগুলিকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবে, যা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্যকে আরও মসৃণ ও সাশ্রয়ী করে তুলবে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বিশেষজ্ঞদের মতে, হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ আন্তঃজাতীয় অর্থনৈতিক করিডর এবং ভুটান-বড়োল্যান্ড-বঙ্গোপসাগর করিডর ভারতের পূর্বাঞ্চলের জন্য, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হতে পারে। বর্তমানে, অসম, মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল প্রদেশ থেকে ৯৫ শতাংশ রফতানি শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমে সড়কপথে পরিবহণ করা হয়। বাকি ৫ শতাংশ নির্ভর করে রেলের ওপর (Economic Corridors)। এই সংকীর্ণ করিডরের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা লজিস্টিক বাধা তৈরি করে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে। প্রস্তাবিত করিডরগুলি বিকল্প বাণিজ্য ও পরিবহণ (Northeast India) রুট দেওয়ার মাধ্যমে চিকেনস নেকের বোঝা কমাতে সাহায্য করবে।
সীমান্ত শেয়ার
প্রসঙ্গত, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি চিন, মায়ানমার, ভুটান ও বাংলাদেশ সহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সীমান্ত শেয়ার করে। দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, বিশেষ করে তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে’র মাধ্যমে, ভারতের জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। প্রস্তাবিত করিডরের মূল অংশীদার বাংলাদেশ এবং ভুটান, পরিকাঠামো প্রকল্পগুলিতে চিনা বিনিয়োগ ক্রমবর্ধমানভাবে প্রত্যক্ষ করেছে। উন্নত যোগাযোগ এবং পরিকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে এই দেশগুলির সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা বেজিংয়ের উপস্থিতির ভারসাম্য বজায় রাখবে এবং এই অঞ্চলে নয়াদিল্লির নেতৃত্ব পুনর্নিশ্চিত করবে।
কৌশলগত দুর্বলতা হ্রাস
এই প্রকল্পগুলি কৌশলগত দুর্বলতা হ্রাস করার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তাও উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করবে। শিলিগুড়ি করিডরে কোনও বিঘ্ন ঘটলে—প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, অথবা নিরাপত্তা হুমকির কারণে—এই নতুন করিডরগুলি উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির জন্য নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করবে। সর্বোপরি, এই করিডরগুলির দ্বারা প্রদত্ত বর্ধিত অ্যাক্সেসযোগ্যতা অনিশ্চিত আশপাশের এলাকায় কোনও নিরাপত্তা হুমকির (Northeast India) ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দ্রুত একত্রিত করার অনুমতিও দেবে (Economic Corridors)।
Leave a Reply