মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: রাশিয়া থেকে অশোধিত তেল কেনা নিয়ে মার্কিন সমালোচনার জবাবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর (S Jaishankar on US Tariff) শুক্রবার কঠোর মন্তব্য করেন। ‘ইকোনমিক টাইমস ওয়ার্ল্ড লিডারস ফোরাম ২০২৫’-এ বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, “আপনার যদি ভারত থেকে (পরিশোধিত) তেল বা পণ্য কেনা নিয়ে সমস্যা থাকে, তাহলে কিনবেন না। কেউ আপনাকে জোর করছে না।” তিনি আরও বলেন, “যে প্রশাসন নিজেকে প্রো-বিজনেস বলে দাবি করে, তাদের মুখে অন্যদের ব্যবসা নিয়ে অভিযোগ শুনে একটু মজাই লাগে।”
কৃষকদের স্বার্থেই সিদ্ধান্ত
আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে খোঁচা দিয়ে এদিন জয়শঙ্কর বলেন, “কাউকে বাধ্য করা হয়নি ভারত থেকে রিফাইন্ড তেল বা অন্য কোনও পণ্য কিনতে।” প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুরে জয়শঙ্কর আরও বলেন, ট্রাম্পের শুল্কবাণের জবাবে ভারতের নীতি খুব স্পষ্ট— কোনওভাবে ভারতবাসীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়, কৃষক-মজুরের স্বার্থে আঘাত লাগে এমন কাজ করা হবে না। ভারতের সিদ্ধান্ত জাতীয় স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত— বিশেষ করে কৃষক ও ক্ষুদ্র উৎপাদকদের সুরক্ষার প্রশ্নে। তিনি বলেন, “আমাদের লাল রেখা হলো আমাদের কৃষক ও মৎস্যজীবীদের স্বার্থ এবং কিছুটা ক্ষুদ্র উৎপাদকদের ক্ষেত্রেও। সেই স্বার্থ রক্ষা করাই আমাদের অঙ্গীকার, এবং তা নিয়ে কোনও আপস নয়।”
রাশিয়ান তেল অনেকেই কিনছে
রাশিয়া থেকে তেল কেনা প্রসঙ্গে জয়শঙ্কর বলেন, “রুশ তেলের বৃহত্তম ক্রেতা চিন। রুশ গ্যাসের বৃহত্তম ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২০২২ সালের পর থেকে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য লাফিয়ে বেড়েছে এমনটাও নয়। ঘটনাচক্রে আমরা আমেরিকা থেকেও তেল কিনি, সেই পরিমাণটাও বেড়েছে। তাই মার্কিন মিডিয়া যে যুক্তি দিচ্ছে সেটা খুবই অগোছালো, ভুলভাল।” অর্থাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রুশ তেল কেনার ‘অপরাধে’ ভারতের উপর অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়েছেন, সেই পদক্ষেপকেই যুক্তিহীন বলে অভিহিত করলেন বিদেশমন্ত্রী। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আমরাই বা টার্গেট হচ্ছি কেন? চিন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা, তাদের ওপর তো এমন কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।”
মার্কিন-পাক সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য
ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে জয়শঙ্কর বলেন, “তাদের একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘ ইতিহাস আছে, এবং তারা নিজেদের ইতিহাসকে ভুলে যাওয়ারও ইতিহাস রাখে। যে সেনাবাহিনী অ্যাবোটাবাদে গিয়ে কাকে পেয়েছিল, মনে আছে তো?”— এই মন্তব্যে ওসামা বিন লাদেনের খোঁজ পাওয়ার ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত করেন তিনি। জয়শঙ্করের কথায়, “এই বিষয়ে ১৯৭০ সাল থেকে ভারতের একটি নির্দিষ্ট নীতি রয়েছে। তা হল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা কারও মধ্যস্থতা গ্রহণ করি না। যদিও ট্রাম্প বারবার মধ্যস্থতার দাবি করে চলেছেন।”
ট্রাম্পের কূটনৈতিক ধরন নিয়ে সমালোচনা
ট্রাম্পের বিদেশনীতি নিয়েও মুখ খোলেন বিদেশমন্ত্রী। বলেন, “বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো গোটা বিশ্ব এমন কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেখেনি যিনি এমন প্রকাশ্যে বিদেশনীতি ঠিক করেন।” রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার বিষয়টিও ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক ঘোষণার আগে আলোচনা হয়নি বলে জানান বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর। ট্রাম্পের অস্বাভাবিক ও প্রকাশ্য কূটনৈতিক স্টাইল নিয়েও কটাক্ষ করেন জয়শঙ্কর। বলেন, “ট্রাম্পের বিশ্ব-সম্পর্কের ধরন ঐতিহ্যগত কূটনীতির থেকে একেবারেই আলাদা। কোনও সিদ্ধান্ত আগে ঘোষণা করা হয়, তারপর আলোচনা হয়— এই রীতির ফলে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “এটা শুধু ভারতের জন্য নয়, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিষয়েও প্রযোজ্য।”
মার্কিন হুমকি ওড়াল ভারত
প্রসঙ্গত, ভারত-আমেরিকার সুসম্পর্ক থাকলেও, সম্প্রতিই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের উপরে প্রথমে ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং পরে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপান। এর পিছনে যুক্তি দেন যে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনে। তবে এই শুল্ক যুদ্ধের আবহে দীর্ঘদিনের ‘বাণিজ্যবন্ধু’ রাশিয়াকে আরও কাছে টানে ভারত। মস্কোর প্রতি বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর আরও মজবুত বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ার বার্তা দেন। রুশ সংস্থাগুলিকে ভারতীয় অংশীদারদের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গেই তাঁকে বলতে শোনা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের সবচেয়ে স্থিতিশীল সম্পর্ক ভারত ও রাশিয়ার। অর্থাৎ ট্রাম্পের হুমকিকে ‘ডোন্ট কেয়ার’ করেই আপাতত এগিয়ে চলেছে ভারতের বিদেশনীতি।
Leave a Reply