মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: শুল্ক-সংঘাত, নয়া ভিসা-নীতির আবহেই নতুন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করল ভারত-আমেরিকা। নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে আগামী এক দশকে প্রতিরক্ষা খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে ওই চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে দশ বছরের জন্য হওয়া এই চুক্তি ভারত ও আমেরিকাকে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার প্রশ্নে আরও কাছাকাছি এনে দিল বলেই মনে করা হচ্ছে ৷ ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে এই প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয় মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিটার হেগসথের৷
ভারত ও আমেরিকার মজবুত সম্পর্ক
শুক্রবার এক্স পোস্টে মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব পিট হেগসেথ এ কথা জানিয়েছেন। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালমপুরে শুক্রবার আসিয়ান প্রতিরক্ষা সম্মলনের ফাঁকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে হেগসেথের বৈঠক হয়। সেখানেই সই হয় দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি। তার পরে এক্স পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আস্থাভাজন হেগসেথ লিখেছেন, ‘‘আমি রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে ১০ বছরের আমেরিকা-ভারত প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো চুক্তি স্বাক্ষর চূড়ান্ত করেছি।’’ মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের দাবি, ওই চুক্তি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও প্রতিরোধমূলক সক্ষমতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এটি দুই দেশের মধ্যে সমন্বয়, তথ্য বিনিময় ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা আরও জোরদার হবে এর মাধ্যমে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা এখন ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে আরও বেশি করে সমন্বয় করে চলেছি ৷ আগের থেকে আরও বেশি পরিমাণে তথ্য় ভাগ করে নিচ্ছি ৷ প্রযুক্তিগত দিক থেকে আদান-প্রদানও বেড়েছে ৷ অতীতে ভারত ও আমেরিকার সম্পর্ক কখনও এতটা মজবুত হয়নি ৷’’
সম্পর্ক আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা
সম্প্রতি ভারতের উপর ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ সেই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর৷ তারপর থেকে ভারত ও আমেরিকার তরফে সেই সম্পর্ককে আবারও আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে ৷ ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিকবার ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন৷ দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে মুখোমুখি বৈঠকও হতে চলেছে দিন কয়েকের মধ্যে ৷ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার ক্ষেত্রে এই প্রতিরক্ষা চুক্তি বড় পদক্ষেপ বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল৷ সরকারি সূত্রের খবর, মালয়েশিয়ায় রাজনাথ-হেগসেথ আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জিই অ্যারোস্পেসের এফ৪০৪ ইঞ্জিনের সরবরাহ। এই ইঞ্জিনের সরবরাহে দেরি হওয়ায় ভারতীয় বায়ুসেনাকে চুক্তির সময়সীমা অনুযায়ী তেজস যুদ্ধবিমান দিতে সমস্যায় পড়েছে রাষ্ট্রয়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (HAL)।
ভারত-মার্কিন সখ্য জরুরি
আমেরিকার সঙ্গে এই ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি আগেও করেছে ভারত ৷ ২০১৫ সালে হওয়া দশ বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়াতেই এবার নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হল দুটি দেশ৷ ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে আলোচনা ইতিবাচক হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং৷ তিনি মনে করেন, এমনিতেই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে গভীর সমন্বয় আছে৷ এই চুক্তি সেই সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। সোশাল মিডিয়ায় করা পোস্টে রাজনাথ লেখেন, ‘‘ভারত ও আমেরিকার প্রতিরক্ষা সমঝোতাকে নতুন দিশা দেখাবে এই চুক্তি ৷ আমাদের পারস্পরিক সমঝোতা যে আগামী দশকে আরও বেশি মজবুত হতে চলেছে সেটা এই চুক্তি থেকেই স্পষ্ট ৷ আগামিদিনে ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান ভিত্তিই হতে চলেছে প্রতিরক্ষা ৷ ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা যাতে মুক্ত ও অবাধ কিন্তু নিয়মবদ্ধ ভাবে পরিচালিত হতে পারে তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারত-মার্কিন সখ্য জরুরি ৷’’
চুক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রাজনাথ সিং ও হেগসেথের সাক্ষাৎ কেবল চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৌশলগত আলোচনার অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই নতুন চুক্তি ভারত–মার্কিন প্রতিরক্ষা কাঠামোকে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে শক্তিশালী করবে, যা দ্বিপাক্ষিক সামরিক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলবে। নতুন চুক্তির মূল কাঠামো তিনটি স্তম্ভকে কেন্দ্র করে গঠিত। উভয় দেশের মিলিতভাবে লজিস্টিক সুবিধা, রক্ষণাবেক্ষণ ও সেনা বাহিনীর সরঞ্জাম ব্যবহার সহজতর হবে। এছাড়াও প্রতিরক্ষা সামগ্রী ও প্রযুক্তির যৌথ উৎপাদন এবং উন্নয়নকে উৎসাহ দেওয়া হবে। পাশাপাশি ভারতের স্বদেশী প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও আধুনিকীকরণকে সহায়তা করার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি স্থানান্তরের সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। এই চুক্তি ভারতের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক ইন্টারঅপারেবিলিটি বা মিলিত কার্যক্ষমতাও বাড়াবে। এর মাধ্যমে উভয় দেশ একে অপরের সেনা ঘাঁটি, লজিস্টিক সুবিধা ও রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র ব্যবহার করতে পারবে, যা দ্বিপাক্ষিক সমন্বয় এবং কৌশলগত প্রস্তুতিতে এক বড় দিক পরিবর্তন আনবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে এই চুক্তি চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিশেষভাবে দক্ষিণ চিন সাগর ও ভারত মহাসাগরে বেজিংয়ের আক্রমণাত্মক নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরিতে সহায়ক হবে।

Leave a Reply