মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ভারতরত্ন অটল বিহারি বাজপেয়ী (Atal Bihari Vajpayee) ছিলেন ভারতীয় রাজনীতির এমন এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যাঁর পরিচয় ক্ষমতা বা পদে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং আদর্শ, মানবিকতা ও দেশভক্তির দ্বারা গড়ে উঠেছিল। তাঁর নামের মতোই ‘অটল’ ছিল তাঁর চরিত্র—দৃঢ় বিশ্বাস, শালীন আচরণ এবং সহমর্মিতায় ভরপুর এক রাষ্ট্রনায়ক। রাজনৈতিক মতভেদ সত্ত্বেও বিরোধীরাও তাঁকে সম্মান করতেন। প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। আস্থা ভোটের আগে লোকসভায় এক অবিস্মরণীয় ভাষণ দিলেন অটলজি। অথবা, তাঁর কাব্যচর্চাকে কটাক্ষ করে কংগ্রেসের তৎকালীন সভানেত্রী সনিয়া গান্ধী বললেন, শুধু কবিতা লিখলে দেশ চলে না। একটুও মেজাজ না হারিয়ে ততোধিক তীক্ষ্ণ শ্লেষে তিনি বললেন, ঠিকই, শুধু কবিতা লিখলে দেশ চলে না, লিখে রাখা ভাষণ জনসভায় গিয়ে পড়লে দেশ দৌড়য়। তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের এমন নানা মুহূর্তের কথা দেশবাসীর মুখে মুখে আজও ঘোরে।
জন্ম-বড় হওয়া, রাজনীতিতে যোগ
১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর গ্বালিয়রে জন্ম অটল বিহারী বাজপেয়ীর (Atal Bihari Vajpayee)৷ অটল বিহারীর পৈত্রিক গ্রাম যদিও ছিল উত্তর প্রদেশের আগ্রা জেলার বটেশ্বরে। সেখান থেকে মধ্য়প্রদেশে গিয়ে বসবাস শুরু করেন অটল বিহারীর ঠাকুরদা শ্যামলাল বাজপেয়ী। তাঁর মা কৃষ্ণা দেবী, বাবা কৃষ্ণবিহারী বাজপেয়ী৷ বাবা ছিলেন কবি, পেশায় স্কুলশিক্ষক৷ কবিতায় হাতেখড়ি বাবার কাছেই৷ গ্বালিয়রের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক হন। পরে কানপুরের ডিএভি কলেজ থেকে স্নাতকোত্তরে উত্তীর্ণ হন প্রথম শ্রেণিতে। ইংরেজি, হিন্দি, সংস্কৃত— বেশ তরুণ বয়সেই তিনটি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন বাজপেয়ী। রাজনীতি বোধ হয় ছিল তাঁর মজ্জায়। ছাত্রাবস্থাতেই ‘আর্যসমাজ’-এর সঙ্গে যুক্ত হন। বাবাসাহেব আপ্তে-র অনুপ্রেরণায় ১৯৩৯ সালে যোগ দেন আরএসএসে। কয়েক বছরের মধ্যেই হয়ে ওঠেন সঙ্ঘের প্রচারক।
স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও যোগ দিয়েছিলেন অটল বিহারী ((Atal Bihari Vajpayee)৷ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন৷ জেল খেটেছিলেন ২৩ দিন। ১৯৫১ সালে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় অটল যোগ দেন ভারতীয় জনসঙ্ঘে৷ দলের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রিয়পাত্রও হয়ে ওঠেন শীঘ্রই৷ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অন্ধ ভক্ত ছিলেন অটলবিহারী। কাশ্মীরে যেতে বিশেষ অনুমতি পত্রকে বাধ্যতামূলক করার বিরোধিতায় ১৯৫৩ সালে আমরণ অনশনে বসেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। একই সঙ্গে অনশনে বসেছিলেন অটল বিহারীও। এই আন্দোলন চলাকালীনই শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু হলে ভেঙে পড়েন অটল বিহারী। ১৯৫৭ সালে উত্তরপ্রদেশের বলরামপুর থেকে বাজপেয়ী প্রথম বার লোকসভায় নির্বাচিত হন৷ ১৯৬৮ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘের সর্বভারতীয় সভাপতি হন।
রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে প্রথম হিন্দিতে ভাষণ
হিন্দিতে তাঁর দক্ষতার জন্য সংসদে বার বার প্রশংসিত হয়েছে বাজপেয়ীর বক্তৃতা। এমনকী, অটল বিহারী একদিন প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। প্রথম ব্যক্তি হিসাবে বাজপেয়ীই রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে হিন্দিতে ভাষণ দেন। হিন্দির প্রসারে সব সময় সক্রিয় ছিলেন তিনি। উত্তর প্রদেশের সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ থাকলেও গোটা দেশে সমান জনপ্রিয় ছিলেন অটল বিহারী। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি গোটা জীবনে চারটি আলাদা রাজ্য থেকে ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছেন। উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাট থেকে সাংসদ ছিলেন তিনি।
বিজেপির প্রথম সভাপতি
১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার অবসান। ইন্দিরা-বিরোধী ঐক্য জোরদার করতে চরণ সিং-এর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় লোক দল এবং মোরারজি দেশাইদের কংগ্রেস (ও) এবং বাজপেয়ী-আডবাণীদের জনসঙ্ঘ মিশে যায়, তৈরি হয় জনতা পার্টি। নির্বাচনে ভরাডুবি হয় কংগ্রেসের। মোরারজি দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে দেশে প্রথম অকংগ্রেসি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। অটল বিহারী বাজপেয়ী (Atal Bihari Vajpayee) সে মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রী হন। নানান মতাদর্শের ‘জগাখিচুড়ি’ জনতা পার্টি অবশ্য বেশি দিন ঐক্যবদ্ধ থাকেনি। ১৯৮০ সালে সাবেক জনসঙ্ঘীরা বেরিয়ে যান জনতা পার্টি থেকে। তৈরি হয় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), যার প্রথম সভাপতি হন বাজপেয়ী।
প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী
১৯৯৬ সালে লোকসভা নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বিজেপি। দেশের দশম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন অটলবিহারী৷ কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না দলের। ম্যাজিক ফিগার জোগাড়ও করতে পারেননি বাজপেয়ী। ১৩ দিনে পতন ঘটে বাজপেয়ী সরকারের। কিন্তু ইস্তফা দেওয়ার আগে যে ভাষণ অটল দিয়েছিলেন লোকসভায়, তা সংসদে প্রধানমন্ত্রীদের দেওয়া স্মরণীয় ভাষণগুলোর অন্যতম হয়ে রয়ে গিয়েছে। বাজপেয়ী সরকার টেকেনি ঠিকই। কিন্তু কংগ্রেস সমর্থন নিয়ে তৈরি হওয়া সংযুক্ত মোর্চা সরকারও বছর দু’য়েকের বেশি টিকতে পারেনি। ফলে ১৯৯৮ সালে ফের নির্বাচনের মুখোমুখি হয় দেশ। আরও বেশি আসন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বিজেপি। ফের সরকার গঠন করে এনডিএ। কিন্তু সে বারও পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেননি বাজপেয়ী। তেরো মাসে সরকার পড়ে যায়। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনের রায়ও ছিল বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের পক্ষেই। তৃতীয় বার সুযোগ পেয়ে প্রথম অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়েন বাজপেয়ী। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় কার্যকালে অটলবিহারী বাজপেয়ী অনেকগুলি ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছিল। রাজকোষ দ্রুত ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। দেশ জুড়ে পরিকাঠামো উন্নয়ন গতি পেয়েছিল।
তাঁর মুখচ্ছবি সহাস্য
এক টালমাটাল সন্ধিক্ষণে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন— এক দিকে জোট রাজনীতির উত্থান, অন্য দিকে দেশের অর্থনীতিতে বড়সড় বদল আনার প্রক্রিয়া। কিন্তু হাজার ঝড়ঝাপ্টা সামলেও অধিকাংশ অবকাশে তাঁর মুখচ্ছবি সহাস্য। আর সর্বোপরি ছিল তাঁর অসামান্য বাগ্মিতা এবং পাণ্ডিত্য। ২৪টি দল নিয়ে গঠিত এনডিএ সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সমন্বয় ও সহাবস্থানের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর সময়েই জাতীয় মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প ও গোল্ডেন কোয়াড্রিল্যাটারালের মাধ্যমে দেশের পরিকাঠামো উন্নয়নে নতুন গতি আসে।
অসাধারণ কূটনীতিক
রাজনীতির মতো, কূটনীতিতেও ভারসাম্যের পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী (Atal Bihari Vajpayee)। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর লক্ষ্যে বড়সড় পদক্ষেপ করেছিল ভারত। তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সঙ্গে নিয়ে ভারত-পাক বাসযাত্রার সূচনা করেছিলেন বাজপেয়ী। বলেছিলেন, ‘‘বন্ধু বদলানো যায়৷ কিন্তু প্রতিবেশী বদলানো যায় না।’’ কিন্তু কার্গিলে পাক অনুপ্রবেশ ও দখলদারির খবর পেয়েই সর্বাত্মক সামরিক অভিযানের নির্দেশ দিতে দ্বিধা করেননি তিনি। অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে পোখরানে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটায় ভারত। তাতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয় নয়াদিল্লিকে। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে ভারতের অভূতপূর্ব সুসম্পর্কের দরজাটাও খুলে দিয়ে যান অটলবিহারী বাজপেয়ী-ই। তাঁর আমলেই ভারত সফরে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন। ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা হয়ে যায় ক্লিন্টনের সেই ভারত সফরেই।
ঐক্য ও দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল প্রতীক
জনসংঘ ও পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টিকে আদর্শিক শক্তি জোগানো এই নেতা সংসদীয় গণতন্ত্রে শালীনতা ও যুক্তিবোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সংসদে তাঁর বক্তৃতা ছিল যুক্তি, রসবোধ ও সৌজন্যের অনবদ্য মিশ্রণ। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বাজপেয়ী লোকসভায় ১০ বার এবং রাজ্যসভায় ২ বার নির্বাচিত হন। জাতীয় স্বার্থকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার এক উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি হয় যখন প্রধানমন্ত্রী পি. ভি. নরসিংহ রাও বিরোধী দলের নেতা হয়েও অটল বিহারি বাজপেয়ীকে জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান। কাশ্মীর ও মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর সংযত অথচ দৃঢ় বক্তব্য ভারতের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে। মতাদর্শগত দিক থেকে বাজপেয়ীর চেয়ে অনেকটা দূরত্বে অবস্থান করা মনমোহন সিং বলেছিলেন, ‘‘অটল বিহারী বাজপেয়ী হলেন ভারতীয় রাজনীতির ভীষ্ম।’’ দীর্ঘ অসুস্থতার পর ২০১৮ সালের ১৬ আগস্ট নয়াদিল্লির এইমসে তাঁর মৃত্যু হয়। ‘সদৈব অটল’ নামে তাঁর স্মৃতিসৌধ আজও তাঁর অবিচল আদর্শের প্রতীক।

Leave a Reply