সুশান্ত দাস
পি ফর পাকিস্তান। পি ফর প্রক্সি। পি ফর প্রোপাগান্ডা। ভারতের পশ্চিম প্রান্তের প্রতিবেশি রাষ্ট্রের জন্য এটা একেবারে ধ্রুব সত্য। ভারতের আত্মায় আঘাত হানার পরিণাম কী ভয়ানক হতে পারে, তা মঙ্গলবার রাতে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে পাকিস্তান। এখনও টের পাচ্ছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর (Operation Sindoor) মাধ্যমে সারাজীবন জঙ্গিদের দিয়ে প্রক্সি ওয়ার বা ছায়াযুদ্ধ চালানো পাকিস্তানের কঙ্কালসার সামরিক শক্তির হাড়ির হাল একেবারে বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে ভারত। ইসলামাবাদ ভালোই বুঝে গিয়েছে, গোলাবারুদের যুদ্ধে (India Firepower) ভারতের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া যাবে না। ফলে, ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে (India Pakistan War) না উঠতে পেরে, পাকিস্তান এখন সেই কৌশল অবলম্বন করেছে, যা তারা ভালো পারে— প্রোপাগান্ডা ওয়ার (Pakistan Propaganda War)। অর্থাৎ, ফেক প্রোপাগান্ডা তৈরি করে চারদিকে প্রচার করো। লক্ষ্য, ভুয়ো তথ্য এবং মিথ্যে খবর এত ছড়িয়ে দিতে হবে যে, যাতে কেউ সত্যিটাকেই না বিশ্বাস করে। সব সত্যি মিথ্যের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। ওই যে কথায় বলে, দশচক্রে ভগবান ভূত! এটাই পাকিস্তানের মন্ত্র। আর তাদের সঙ্গী হিসেবে এই মিথ্যে তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযানে অবতীর্ণ তাদের বি-টিম (অর্থাৎ, বি ফর বাংলাদেশ)। এটা একেবারে বাস্তব। করাচি ও রাওয়ালপিন্ডি থেকে যখন যা নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে পদ্মাপাড়ে বাস করা মৌলবাদীর দল।
নেটওয়ার্ককে অ্যাক্টিভেট পাকিস্তানের…
মঙ্গলবার গভীর রাতে পাকিস্তান ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালিয়ে ৯টি জঙ্গি-ঘাঁটি ধ্বংস করেছে ভারত। ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিল ভারতীয় বায়ুসেনার রাফাল যুদ্ধবিমান। বুধবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা ফেক প্রোপাগান্ডা (Pakistan Propaganda War) নেটওয়ার্ককে অ্যাক্টিভেট করে ইসলামাবাদ। ব্যাস, কালক্ষেপ না করে কাজে লেগে পড়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ‘সাইবার-জেহাদি’রা। ভুলে গেলে চলবে না, তাতে যোগ দেয় ভারতেও বসবাসকারী গুটিকয়েক পাক-সমব্যথী। গোড়া থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ভারতের অভিযানকে (Operation Sindoor) ‘ব্যর্থ’ দেখানোর শত চেষ্টা করা হয় এবং এখনও হয়ে চলেছে। এর জন্য গড়ে তোলা হয়েছে একের পর এক ফেক বা ভুয়ো ন্যারেটিভ (Fake Narrative) ও স্টোরি। আর সেই ভুয়ো তথ্যকে সমাজমাধ্যমে সত্যি বলে চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক প্রযুক্তিগত ও ছলচাতুরি কৌশল।
সমাজমাধ্যমে ভুয়ো দাবির বম্বিং…
কখনও বলা হয়েছে, ভারতের তিন রাফাল (Rafale Shotdown) সহ পাঁচটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করা হয়েছে। ভারতের পাইলটকে আটক করা হয়েছে। তো কখনও বলা হয়েছে পাকিস্তান ভারতের শ্রীনগর, অমৃতসর বায়ুসেনা ঘাঁটি ধ্বংস করেছে। আবার কখনও বলা হয়েছে ভারতের একটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার নাকি গুঁড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। এখানেই শেষ নয়। কোথাও এও দেখানো হয়েছে যে, ভারতীয় সেনা সাদা পতাকা হাতে আত্মসমর্পণ করেছে। প্রত্যেকটি দাবির (Pakistan Propaganda War) ক্ষেত্রে কখনও পুরনো ছবি, তো কখনও বিদেশের ছবি তো কখনও দাবানলের ছবিও ব্যবহার করে ভারতের বিরাট ক্ষতি করা হয়েছে বলে দেখোনোর চেষ্টা চলছে। এমনকি, ভিডিও গেমসের ফুটেজকে ব্যবহার করেও চালানোর চেষ্টা হয়। যুদ্ধবিমানের ড্রপ-ট্যাঙ্ক (যুদ্ধবিমানের ডানায় থাকা অতিরিক্ত জ্বালানির ট্যাঙ্ক, যা খালি হলে ফাঁকা জায়গা দেখে মাঝ-আকাশ থেকেই ড্রপ বা ফেলে দেওয়া হয়) দেখিয়ে বলা হয়েছে এটা রাফালের ধ্বংসাবশেষ। আবার কোথাও, প্রযুক্তির সাহায্যে রাফাল বিমানের নকল ছবি দেখিয়ে বলা হয়েছে— এই যে রাফাল ধ্বংস হয়েছে।
এআই-এর নজরে সবকিছুই…
সম্প্রতি এমনই একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দিয়েছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ‘সাইবার-জেহাদি’দের দল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মাঠে পড়ে রয়েছে একটা ধাতব টুকরো, যার সঙ্গে যুদ্ধবিমানের টেল(লেজ) অংশের দৃশ্যত মিল রয়েছে। ওই টুকরোর এক প্রান্তে ইংরেজি হরফে লেখা ‘BS 001’। অন্যদিকে, ইংরেজিতে লেখা ‘Rafale’। দাবি করা হয়, এটি ভারতের প্রথম রাফাল যুদ্ধবিমানের লেজের অংশ। প্রমাণ হিসেবে, ভারতীয় বায়ুসেনার রাফাল যুদ্ধবিমানের ছবি দেখানো হয়, যাতে লেজের দিকে এই দুই শব্দবন্ধ জ্বলজ্বল করছে। এক ঝলকে দেখে জনসাধারণের মনে হতেই পারে, এটা রাফাল যুদ্ধবিমানেরই অংশ। কিন্তু, প্রযুক্তি-কারবারিরা সহজেই ধরে ফলেবে কোথায় কারচুপি করা হয়েছে। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগ। এআই ব্যবহার করে যেমন ভুয়ো জিনিস সহজেই তৈরি করা যায়, তেমনভাবেই, সহজেই ভুয়ো জিনিস ধরাও যায়। এছাড়া, ‘ডুপ্লিচেকার’ বা ‘রিভার্স ইমেজ সার্চ’ সহ ইন্টারনেটে একাধিক ‘টুল’ এবং ওয়েবসাইট আছে, যা দিয়ে এধরেনর কারচুপি ও সত্য-মিথ্যে যাচাই করা যায়। এমনকি, এক্স হ্যান্ডলের (সাবেক ট্যুইটার) নিজস্ব এআই প্ল্যাটফর্ম ‘গ্রোক’-ও জানিয়ে দিয়েছে, এই (পাকিস্তানের) দাবি ভুয়ো। এই দাবির কোনও সারবত্তা নেই। ইসলামাবাদের কুকীর্তি দুনিয়ার সামনে ফাঁস করে দেয় মার্কিন সমাজমাধ্যম সংস্থা (Pakistan Propaganda War)।
রাফালের লেজ-বিতর্ক…
পাকিস্তানের ফেক প্রোপাগান্ডা ধরে পড়ে যায় সেখানেই। দেখা যায়, রাফালের ছবি বলে বিভিন্ন পাকিস্তানি, বাংলাদেশি ও ভারত-বিরোধী হ্যান্ডল থেকে প্রচার করা হচ্ছে যে ছবি, তা আদতে ৭ মাস পুরনো। সেই ছবিতে এডিট করে ‘BS 001’ এবং ‘Rafale’ শব্দটি জুড়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাহলে তফাত কোথায়? দেখা যাচ্ছে দুটো ছবির মধ্যে আসল রাফালের টেল সেকশনের নাম্বারিং এবং ফেক এডিটিং করা ছবির অক্ষরের পজিশন ও তার আকারে পার্থক্য আছে। এটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ছবি তো না হয় এডিট করা যাবে। কিন্তু, রেকর্ড তো থেকে যাবে! আর ভারতীয় বায়ুসেনায় রাফালের কোড অন্য কথা বলছে। বায়ুসেনায় বর্তমানে দুটি রাফাল স্কোয়াড্রন আছে। একটা পশ্চিমে পাক-সীমান্ত লাগোয়া আম্বালায়। অন্যটি পূর্বে চিন-সীমান্ত লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারায়। আম্বালাস্থিত ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনে থাকা রাফালগুলির বিমানের টেল (লেজে) ইংরেজি হরফে ‘RB’ থাকে, প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আরএস ভাদৌরিয়ার নামে। অর্থাৎ, এই স্কোয়াড্রনের সবকটি বিমানগুলি ‘RB’ সিরিজের। অন্যদিকে, হাসিমারাস্থিত ১০১ স্কোয়াড্রনে থাকা রাফালগুলির লেজে রয়েছে ‘BS’। এটা প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল বিএস ধানোয়ার নামে। এখানকার বিমানগুলি ‘BS’ সিরিজের। এটা বোধহয় ‘সাইবার-জেহাদি’রা জানত না। বা তাড়াহুড়োয় ভুল করে ফেলেছে। যার ফলে, এই কাঁচা কারচুপির কাজ ধরা পড়ে গেছে। কারণ, তাদের দাবি অনুযায়ী, আম্বালা বাদ দিয়ে হাসিমারা থেকে রাফাল পাঠানো হয়েছিল ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ (Operation Sindoor) অংশ নিতে! যুক্তি ও বাস্তব জ্ঞান বলে, এটা হতে পারে না, এটা অবাস্তব। ফলে, ‘সাইবার-জেহাদি’দের দাবিকে হাস্যকর বললেও কম বলা হয়।
রাফাল-ন্যারেটিভের নেপথ্য…
কিন্তু, হঠাৎ, রাফাল ধ্বংসের ভুয়ো ন্যারেটিভ নিয়ে কেন এত মাতামাতি পাক ‘সাইবার-জেহাদি’দের? এর নেপথ্যে রয়েছে এক সুনির্দিষ্ট অপ-কৌশল। কী সেটা? পাকিস্তান ভালো করেই জানে, ভারতীয় বায়ুসেনার অন্যতম শক্তিশালী অংশ হল রাফাল যুদ্ধবিমান। অত্যন্ত সচতুরভাবে এই ‘সাইবার-জেহাদি’রা রাফালকে টার্গেট করে। কীভাবে? বুধবার ভোর থেকেই খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়, পাকিস্তান ভারতের তিনটি রাফাল যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে। একটা বিষয় পরিষ্কার। এই ‘সাইবার-জেহাদি’রা জানে যে, রাফাল হল বিশ্বের অন্যতম সেরা এবং এই মুহূর্তে ভারতের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিমান। ফলে, এই বিমান ধ্বংস হয়েছে শুনলে ভারতীয়দের মনোবলে চিড় ধরবে। তাদের আত্মাভিমানে ধাক্কা লাগবে। পাকিস্তান ও তাদের বি-টিম ভীষণভাবে, যাকে বলে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু, ভারতকে টলানো সম্ভব নয়। ভারত ওদের এক কাঠি ওপরে, ওরা সেটা ভুলে গিয়েছে। তাই, পাকিস্তানের এই ফেক ন্যারেটিভ ভারত, মায় বিশ্ব ধরে ফেলেছে।
যস্মিন দেশে যদাচার…
‘সাইবার-জেহাদি’দের ফেক প্রোপাগান্ডাকে হাতিয়ার করে গত ৩৬ ঘণ্টায় বেশ লাফালাফি করছে পাকিস্তানের তাবড় তাবড় নেতা-মন্ত্রীরা। কিন্তু, সত্য তো আর চাপা থাকে না। তা ঠিক বেরিয়ে আসে। ফলে, পাকিস্তানের চিনা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মতো তাদের রাফাল ধ্বংসের ভুয়ো ন্যারেটিভ মুখ থুবড়ে পড়তেই পালানোর পথ পাচ্ছেন না তাঁরা। রাফাল ধ্বংসের প্রমাণ আছে কিনা জানতে চেয়ে পাক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খোয়াজা আসিফকে এই নিয়ে প্রশ্ন করেছিল বিদেশি সংবাদমাধ্যম। অন-এয়ার পাক মন্ত্রী বলছেন, ‘‘প্রমাণ তো সোশ্যাল মিডিয়ায় রয়েছে’’! যখন তাঁকে ফের প্রকৃত তথ্য বা প্রমাণ পেশ করতে বলা হয়, তখন তিনি পালানোর পথ খোঁজেন। এই হচ্ছে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অবস্থা। সেদেশের প্রতিরক্ষার কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়। অবশ্য, তিনি একা নন। খোদ পাক প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফও ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’-তে দাঁড়িয়ে ভারতের বিমান ধ্বংস করার দাবি করে নিজের দেশের সেনাকে বাহবা দিয়েছেন। সেখানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এসব বলবেন, সেটাই কাম্য। এর চেয়ে বেশি পাকিস্তানের থেকে আশা করাটাও ভুল। এদের চেয়ে বরং বিচক্ষণতা দেখিয়েছে পাক সেনার জনসংযোগ বিভাগ। বিবৃতিতে ভারতের অভিযানের (Operation Sindoor) কথা স্বীকার করলেও, সেখানে কোনও ভারতীয় যুদ্ধবিমানকে মেরে নামানোর কথা উল্লেখ করা হয়নি।
ফলে একটা বিষয় পরিষ্কার। পি ফর প্যাথেটিক। পাকিস্তান এরকমই ছিল, আছে ও থাকবে।
Leave a Reply